Posts

Showing posts from 2017

চেতন শক্তি ১

  চেতনা হল আত্মসত্ত্বা। চেতনাবিহীন আমরা জড় পদার্থ। ভগবান, আল্লা, গড, ব্রহ্ম - চতনা ছাড়া এর অস্তিত্ব নেই। জ্ঞানীর নিরাকার চেতনা হল ব্রহ্ম। ভক্তের সাকার চেতনা হল ভগবান।    চেতনা সকলের মধ্যে আছে। কিন্তু সকলে চেতনার মধ্যে নেই। ব্যাক্তি যখন চেতনাময় হয় সেটি হল তার চৈতন্য অবস্থা।    সাধারণ অবস্থায় আমরা চেতন জগতকে ছেড়ে জড় জগতকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি।   চিন্তাই চেতনার বন্ধনের কারণ।   যথার্থ পূজা হলে ব্যক্তি নিজ চেতনা থেকে মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং সেই জাগ্রত মূর্তিতে পূজা করেন।   সাধনার উদ্দেশ্য হল চেতনাকে যা ভুলিয়ে রাখে সেগুলিকে অন্তর থেকে সরিয়ে চেতনায় ( যা আমাদের জন্মগত) যুক্ত থাকা।  চেতনার - ১। অচেতন অবস্থা = মূলাধার চক্র ২। অপচেতন (পশু চেতন) =  স্বাধিষ্ঠান চক্র ৩। অবচেতন অবস্থা = মণিপুর চক্র                                   প্রথম তিনটি হল বন্ধন বা সীমাবদ্ধ অবস্থা।। ৪। অভিচেতন অবস্থা = অনাহত চক্র ৫। অধিচেতন অবস্থা = বিশুদ্ধ চক্র ৬। সচেতন...

নানা কথা 1

   আমাদের মনে যখন কোনও একটা কিছু পাবার বা করবার ইচ্ছা জাগে তার মূলে আছে সংঘাত। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা ও ত্বক এর সাথে সংঘাত হয় বহির্জগতের শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধের। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সাথে মনের সংঘাতে সৃষ্টি হয় ইচ্ছা। কামনা, ভাব ও বিভাব, এই তিন রকমের ইচ্ছা আমাদের প্রকৃত সত্য থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। আমাদের যাবতীয় জাগতিক ইচ্ছাকে চরিতার্থ করবার জন্যই আমাদের বারবার এই পৃথিবীতে আসতে হয় জন্ম নিয়ে।   ইন্দ্রিয়ের সাথে বস্তুর সংঘাতে বেদনার উত্‌পত্তি হয়। জরা, ব্যাধি, মৃত্যুর হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় এই সত্যকে উপলব্ধি করে জন্ম ও কর্মের বাইরে যাওয়া।    তিব্বতে তন্ত্রর মানে হচ্ছে জগত্‌-রহস্য জানা, দেহের রহস্য জানা, জন্ম-মৃত্যুর রহস্য জানা। তন্ত্র মন্ত্র যারা গ্রহণ করে তাদের চার অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে সাধনা করতে হয়।   ১ম অধ্যায় হল ক্রিয়া তন্ত্র   ২য় অধ্যায় হল কার্য তন্ত্র   ৩য় অধ্যায় হল যোগ তন্ত্র    ৪র্থ অধ্যায় হল অনুত্তরা যোগতন্ত্র।    ক্রিয়া তন্ত্রের থেকে কার্য তন্ত্রে ধারণা ও ধ্যানের অভ্যাস বেশী করতে হয়। যোগতন্ত্...

চর্যা 15

শেষ পর্ব 'গঙ্গা জউনা মাাঝে রে বহই নাঈ ' - এই গঙ্গা-যমুনার মধ্যে থাকা নদী হল ঈড়া -পিঙ্গলার মাঝে থাকা সুষুম্না নাড়ী। যোগ সাধনায় এর ব্যাখ্যা আছে।   সব সাধন পথেরই এক মূল গত ঐক্য আছে। সরহপাদ বলছেন, 'এথ্থু সে সুরসরি জমুনা এথ্থু সে গঙ্গাসাঅরু এথ্থু পআগ বনারসি এথ্থু সেছচন্দ দিবাঅরু - এখানেই (এই দেহেই) প্রয়াগ, যমুনা,বারাণসী। এখানেই সূর্যচন্দ্র, গঙ্গাসাগর।  দেহতত্বের এই সাধন প্রক্রিয়া আজও সহজিয়া বাউল-ফকির সাধকদের মধ্যে পাওয়া যায়।   হিন্দুধর্মের কালের দোষে কঠোরতা ও সংকীর্ণতা এলে বৌদ্ধ ধর্মাদির সৃষ্টি। একই কারণে কালের স্রোতে বৌদ্ধ ধর্মে এল সহজযান । কিন্তু সনাতন দর্শনগুলি তো হারিয়ে গেল না। সরহপাদ বললেন, ' গম্ভীরই উআহরণে ণউ পর ণণ অপ্পান' -- গম্ভীরভাবে বিচার করলে দেখা যায় আপন কেউ নয়, আবার পরও কেউ নয়। অন্যতম শ্রেষ্ঠ আচার্য কান্হ্নপাদ বললেন, 'ভব জাই ণ আবই এসু কোই' -- এই ভব সংসারে কেউ আসেও না কেউ যায়ও না।   যদি সারকথা জিজ্ঞাসা করা হয়, যদি এই নশ্বর দেহে ঈশ্বর তথা তীর্থের অবস্থানের প্রমাণ চাওয়া হয় তাহলে শ্রেষ্ঠ আচার্য লুইপাদের ভাষায় বলতে হয় - 'কাহেরে কিস ভণ...

চর্যা 14

"সোনে ভরিলী করুণা নাবী রূপা থই নাহিক ঠাবী।" - আমার করুণা নৌকা সোনা  (শূন্য তথা সত্য জ্ঞান )। সেখানে রূপা অর্থাৎ রূপজগৎ তথা ইন্দ্রিয়জগতের  কোন ঠাই নাই । নাগার্জুন পাদ বলেছেন -- 'যাবান্ কশ্চিৎ বিকল্পঃ প্রভবতি মনসি ত্যাজ্য রূপো হি তাবান্....... -- মনে যা কিছু বিকল্প উদিত হয়, তা-ই ত্যাজ্য । যা পরম সুখকর আনন্দরূপ তাও, যা বৈরাগ্য ভাব আনে তা-ও । নির্বিকল্প চিত্ত ছাড়া নির্বাণ নাই ।    চিত্ত হল আসল। জ্ঞানসম্বোধি বলছে- ' চিত্তমেব মহাবীজং ভবনির্বাণয়োরপি সংবৃতৌ সংবৃতিং যাতি নির্বাণে নিঃস্বভাবতম্ ' -- ভব ও নির্বাণেও চিত্ত ই হল মহাবীজ। সংবৃত্তি তে তা রূপলাভ করে , নির্বাণে নিঃস্বভাব হয়। (সংবৃত্তি ও পারমার্থিক বোধিচিত্ত পূর্বে আলোচিত)। আগম বলেছে - 'করোতি জড়তাম অক্ষ্ণোঃ শিরশ্চাবনম্রতাং স্তৈমিত্যং চিত্তচৈত্তানাং শূন্যতা শূন্যতেক্ষির্ণাং । -- চক্ষুর স্তৈমিত্য ও মস্তকের অবনম্রতা সম্পাদন করো। চিত্তবৃত্তির স্তৈমিত্যই হল শূন্যতা । চক্ষুর স্তৈমিত্যই শূন্যতা ।   এভাবেই লাভ হবে তথতা বা নির্বাণ।

চর্যা 13

   হিন্দু তন্ত্রে শিব কে 'আদিনাথ ' বলা হয়। আবার, নাথ ধর্মে প্রথম নাথ হলেন 'আদিনাথ '। এদিকে আবার,  বৌদ্ধ তন্ত্রে বজ্রসত্ব বা হেবজ্র বা হেরুক কে 'আদিনাথ ' বলা হয়েছে ।      মূলগত মিল থাকলেও( তান্ত্রিক মহাযানী দেবতা হলেন হেরুক ও নৈরাত্ম যোগিনী) এদের সাধন পদ্ধতিগুলিতে কিছু পার্থক্য আছে । নাথপন্থী হঠযোগে 'মূলবন্ধ', 'জালন্বর বন্ধ', ও 'ওড্ডিয়ান বন্ধ' হল সাধনার তিনটি শ্রেষ্ঠ পথ। লুইপাদ এসব দরকার নেই বলছেন । তিনি বলছেন - " এড়িএউ ছান্দক বান্ধক করণক পাটের আশ সুনুপাখ ভিড়ি লেহুড়ে পাস । -- ছন্দের বন্ধন ও ইন্দ্রিয়ের পটুতার আশা পরিত্যাগ হোক। শূন্যরূপ পাখার প্রতি মনোনিবেশ করো।    চর্যা হল 'সহজ পন্থা '।  প্রত্যেক জীব তথা বস্তুর একটি সহজ স্বরূপ আছে। এটি সকল পরিবর্তনশীলতার মাঝে অপরিবর্তিত স্বরূপ । এই সহজ স্বরূপকে উপলব্ধি করে মহাসুখে মগ্ন হতে হবে।    এপথে পাপ-পূন্য দুইই হল বন্ধন। মহীধরপাদ বলছেন, 'পাপ পুন্ন বেণি তোড়িঅ সিকল মোড়িঅ খম্ভাঠাণা' - পাপ-পূন্য উভয়েরই শিকল ছিড়তে হবে। আসলে পাপ পূন্য বলে কিছু নেই । কর্মফল আছে। শূন্যতা বা নির...

চর্যা 12

       483 BC তে রাজগৃহে প্রথম বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি (মহা সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হল মহাকাশ্যপের নেতৃত্বে । দীর্ঘ  7 মাস আলোচনার পরে 'স্থবিরবাদ' চালু হল। তার মূল সূত্র হল ধর্ম ও বিনয় ।        383 BC তে ঠিক 100 বছর পরে বৈশালী তে দ্বিতীয় মহা সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হল। ততোদিনে বৌদ্ধদের মধ্যেই তীব্র মতপার্থক্য গড়ে উঠেছে।  নব্যরা নিজ নির্বাণের পাশাপাশি জগতের মুক্তির কথাও বলছিল । স্থবিরগণ ছনব্যপন্থী 10,000 জন ভিক্ষুককে বহিষ্কার করেন । বহিষ্কৃতরা বৈশালিতেই পাল্টা সম্মেলন করেন। নিজেদের নাম দেন ' মহাসাঙ্ঘিক'। এই মহাসাঙ্ঘিক থেকেই 'মহাযান' ধারার উদ্ভব ।     247 BC তে অশোকের রাজ্যকালে পাটলিপুত্রে তৃতীয় মহাসঙ্গীতি হয় । এই সময়ের পর থেকেই ভারতে স্থবিরবাদ গুরুত্ব হারায়। ছড়িয়ে পরে সিংহল, ব্রহ্মদেশ , শ্যাম দেশে ।      কনিষ্কের আমলে চতুর্থ মহাসঙ্গীতি হয়।  এতে 'অভিধর্ম' সংকলিত হয়।     এর পরই বাংলাতে মহাযানী ও তন্ত্র মিলিত হয়ে 'বজ্র যান ' সাধনার উদ্ভব,  যা পরবর্তীতে বাংলায় পট পরিবর্তনের ফলে তিব্বতে আশ্রয় নেয় ।     ...

চর্যা 11

   বাংলা  ( পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে ) যে সাধন-ভজনের পীঠস্থান সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই । রামকৃষ্ণ - বামাক্ষেপার পাশাপাশি অসংখ্য মাজার শরীফ বাংলাতেই আছে । আধুনিক যুগ ছেড়ে যদি অতীতে পা বাড়াই দেখতে পাব, 1. বৌদ্ধ তন্ত্র 2. নাথধর্ম 3. সহজ যান  তথা সহজিয়া সাধনা  এই দুয়েরই জন্ম, বিকাশ ও বিস্তার বঙ্গভূমি থেকে । 51 শক্তিপীঠের বিরাট সংখ্যক রয়েছে এখানে । বঙ্গভূমি শক্তিপীঠের মাধ্যমে তান্ত্রিক সাধনার জন্য একদা বিখ্যাত ছিল । বীরাচার সাধনার জন্য 'বীরভূম (বীরভূমী)' জেলার নামকরণ হয়।     মহাবীর জৈন এর অপর নাম ছিল 'বর্ধমান'। তার স্মৃতিতে বর্ধমান জেলা ও শহরের নামকরণ হয় । এমনকি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আধ্যাত্মিক গুরু ভদ্রবাহু ছিলেন পৌন্ড্রবর্ধনের মানুষ।    আমরা সাধারণ আস্তিক  মানুষ ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক রাখি মূলতঃ দুভাবে - 1। তিনি সর্বশক্তিমান রাজাধিরাজ । আমরা তার কাছে প্রার্থনা করি । তিনি কৃপা করেন । কৃপা পাব কি পাবনা জানি না । শুধু তার দরবারে নত হয়ে আবেদন করতে পারি । প্রার্থনা মঞ্জুর হলে খুশি হই। না হলে বিমর্ষ হই। 2। মনে করি আমরা তার-ই সন্তান  (অমৃত...

চর্যা 10

'নৈব ক্কচিৎ পুরা বদ্ধোহধুনা মুক্তির্ন বিদ্যতে' ---আগম --পূর্বেও কোথাও বন্ধন ছিল না,  এখনও কোথাও মুক্তি নেই । এই কথায় বিসম্বাদ হতে পারে । মুক্তি যদি নেই তাহলে কিসের সাধনা ? আসলে আত্মা সর্বদাই মুক্ত। সরহ পাদের কথায় - 'চিঅরাজ সহাবে মুকল' - চিত্তরাজ স্বভাবতই মুক্ত । আমরা তাকে বদ্ধ করেছি । কাহ্নপাদ বলছেন, ' চিঅ সহজে শূণ সংপুন্না' - চিত্ত সহজাবস্থায় সম্পূর্ণ শূন্য । আরও বলছেন, 'মূঢ়া অচ্ছন্তে লোঅ ন পেখই দুধ মাঝে লড় ণ চ্ছন্তে দেখই' - দুধের মধ্যে থাকা ননী যেমন দেখা যায় না, মূঢ় তেমনই চিত্তবৃত্তির শূন্যতা দেখতে পায় না । ভুসুকপাদ বলেছেন, 'জঁবে মুসা অচার তুটঅ ভুসুক ভণঅ বান্ধন ফিটঅ' -- মুষিকের(আমাদের ) এই চ'রে বেড়ানো বন্ধ হলেই বন্ধন কাটবে। দারিকপাদ বলেছেন, 'রাআ রাআ রাআ রে অবর রাঅ মোহে রে বাধা' - রাজা রাজা রাজা    মোহে পড়ে বাধা আমরা সকলেই রাজা । শুধু মোহে আবদ্ধ হয়ে আছি। তাই আসলে বন্ধনও নেই,  তাই বন্ধন থেকে মুক্তির প্রশ্নও নেই । সরহপাদের কথায় - 'হাথেরে কাঙ্কণ মা লেই দাপণ অপনে অপা বুঝ তু নিঅমন। -  হাতের কঙ্কণ দেখার জন্য আ...

চর্যা 9

চর্যা  9 "ঘরে অচ্ছই বাহিরে পুচ্ছই পই দেকখই পড়িবেসী পুচ্ছই।। - যা ঘরে আছে তাই বাইরে খুজছ । পতি কে দেখে ও প্রতিবেশী র কাছে খুজছ। অর্থৎ সব তোমার আমার কাছে ই আছে । এদিক ওদিক খোঁজ করার দরকার নেই । 'তান- জুর' - চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদ। এর থেকে জানা গেছে যে মুনি দত্ত ছাড়া ও চর্যার আরও টীকাকার ছিলেন । যেমন,  আর্যদেব, শাক্য মিত্র, দীপঙ্কর পন্ডিত । চীন, জাপান, কোরিয়ান ও মোঙ্গলীয় ভাষাতে এর অনুবাদ হয়েছিল । 'জামে কাম  কি কামে জাম' - সরহ পাদের এটি প্রশ্ন । জন্ম থেকে কর্মের সৃষ্টি,  নাকি কর্ম বা কর্মফলের কারণে মানুষের জন্ম ?    বুদ্ধ যে বললেন, দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে । দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব, দুঃখ নিবৃত্তির উপায় আছে । এই নিবৃত্তি হলে হবে নির্বাণ ।     সহজ যান সাধনা তে সব কিছুই সহজ । কঠোর কৃচ্ছসাধন করা দরকার নেই ।  নির্বাণ লাভের পদ্ধতি কি  ?   আগম শাস্ত্র বলেছে, ' ভবস্যৈব পরিজ্ঞানে নির্বাণ মিতি কথ্যতে" - সৃষ্টির বোধের দ্বারা ই এটি লাভ করা সম্ভব । সৃষ্টি তত্ত্ব বুঝতে হবে । জগত জটিল নয়, সহজ । সহজ পথেই নির্বাণ লাভ সম্ভব ।  শ্রীহে...

চর্যা 8

চর্যা 8 শান্তিপাদ ( ইনি অতীশ দীপঙ্করের গুরু ) বললেন - " কূলে কূল মা হোহি রে মূঢ়া উজুবাট সংসারা ....  জে জে উজূবাটে গেলা অনাবাটা ভইলা সোঈ । - ওরে মূঢ়, কূলে কূলে ঘুরো না। সংসার হল সোজা পথ। যে যে সোজা পথে গেল আর তারা ফিরল না (  অর্থাৎ নির্বাণ লাভ হল, আর পুনর্জন্ম হল না )।    উনি আরও বললেন - "মাআমোহ সমুদারে অন্ত ন বুঝসি থাহা.... সুনা পান্তর উহ ন দীসই ভান্তি ন বাসসি ভান্তে । - মায়ামোহ সমুদ্রের অন্ত বোঝা যায় না। শূন্য প্রান্তরের দেখা না পেলেও যেতে যেন ভুল না হয়।   অর্থাৎ  হৃদয় বৃত্তি লুপ্ত হলে প্রান্তর দিশাহীন বোধ হতে পারে । তবে থেমে যাওয়া চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে।     এ বিষয়ে আগম শাস্ত্র বলছে -  " দগ্ধা মায়াপুরং রম্যং সহসা জ্ঞানবহ্নিনা পশ্যন্তি সততং শূন্যং দিব্যনেত্রা হি যোগিনঃ। -- জ্ঞানাগ্নীর দ্বারা রম্য মায়াপুরকে হঠাৎ দগ্ধ করে দিব্যনেত্রে যোগীরা শূন্যতাকে সতত দেখেন।     সহজ যান সাধনা তে সব কিছুই সহজ । কঠোর কৃচ্ছসাধন করা দরকার নেই । শ্রীসমাজ বলছে " পঞ্চ কামন পরিত্যজ্য তপোভির্ণ চ পীড়য়েত.... --- পঞ্চ কাম ত্যাগ করে তপস্যা য়...

চর্যা 7

চর্যা 7 চর্যার যে গানগুলি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে 1906 সালে উদ্ধার করেছিলেন তাতে পদ বা গান ছিল 50 টি। লালন ফকিরের দেহতত্বের গানগুলিকে observe করলে আমরা তার পূর্বসূরী হিসাবে চর্যাপদগুলিকে বুঝতে সুবিধা হবে।    100 বছর আগে শাস্ত্রীজীর আবিস্কার প্রকাশিত হতেই বাংলা ভাষার আদিরূপ আবিস্কারের আনন্দে এই চর্যাগীতির আভ্যন্তরীন সাধন-ভজনের দিকটি অনালোচিত থেকে যায়। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সামনে আসে এর সহজিয়া সাধন কথা।  চর্যা গাওয়া কেন হতো ?   সাধনার অঙ্গ হিসাবে গান বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। সে ভক্তিগীতি হোক, বা বৈষ্ণব গীত বা বাউল -ফকিরদের গান। গানের কথায় সুরে ইঙ্গিতে সাধনার চর্চা বরাবরের।    শশিভূষণ দাশগুপ্ত পরবর্তীকালে আরো শতাধিক চর্যাগীত উদ্ধার করলেও মুনিদত্তের ব্যাখ্যা সমন্বিত প্রথম 50 টি ই আজও আলোচিত বেশি।      ঐ 50 পদের রচয়িতা হিসাবে 24 জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সর্বাধিক বিখ্যাত হল কাহ্ন পাদ। ইনি কখন্ও কৃষ্ণাচার্য নামেও পরিচিত। চর্যা ছাড়াও কাহ্নপাদ রচিত ' হে বজ্রপঞ্জিকা যোগরত্নমালা' নামক তান্ত্রিক গ্রন্থের পান্ডুলিপি C...

চর্যা 6

চর্যা 6 " দশমি দুয়ারত চিহ্ন দেখইআ   আইল গরাহক অপনে বহিয়া। পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা ... -- বিরুআ পাদ ( ত্রিপুরাতে জন্ম, দেবপালের সমসাময়িক, বিরুআ বজ্র গীতিকা- র রচয়িতা) শুড়িনি ( নৈরাত্মাদেবীর রূপক, তিনি কখনও ডোম্বী, ঈখনও শবরী) দশমী দুয়ারে চিহ্ন দিয়ে রাখেন। যারা বোধিচিত্তের প্রত্যাশী, তারা সে পথে শুড়িখানায় প্রবেশ করে এবং আর বের হয় না। অর্থাৎ নির্বাণ লাভ করে ।   বোধিচিত্ত দেহে কিভাবে প্রবেশ করে ? শরীরের নয়টি রন্ধ্রপথ বা নবদ্বার ( চক্ষু 2, কর্ন 2, নাক2, মুখ, পায়ু ও উপস্থ) এর একটি দিয়েও নয়। প্রবেশ করে অতিরিক্ত দশম রন্ধ্র দিয়ে। বৌদ্ধ দর্শনে একে ' বৈরোচন দ্বার' বলে। বুদ্ধ যেভাবে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন ঠিক সেই ভাবে। সম্ভবত তান্ত্রিক মতে একেই বলে ব্রহ্মরন্ধ্র।   চিখিলপাদ আবার বলছেন - " ভবনই গহন গম্ভীর বেগে বাহী " --  জীবননদী গহন ও গম্ভীর। তার দুদিকে পাঁক, মধ্যিখানে অতল ঠাই। যোগসাধনার সাঁকো দিয়ে পার হতে হবে। গুন্ডরী পাদ বলছেন- " খেপহুঁ জোইনি লেপ ন জাঅ -- -- যোগিনী, ক্ষিপ্ত হও, লিপ্ত হয়ো না। কারন সরহপাদ জানিয়েছেন - " অপানে রচি রচি ভবনির্মাণা   মিছে লোঅ...

চর্যা 5

চর্যা  5 "দিবসই বহুড়ি কাউই তরে ভাঅ  রাতি ভইলে কামরু জাঅ ।। "অইসনি চর্যা কুক্কুরী পাএ গাউই কোড়ি মাঝে একু হি অহি সমাইউ।।   কুক্কুরী পাদ( উনি 800 AD নাগাদ ধর্মপাল-দেবপালের আমলে জীবিত ছিলেন। তারানাথ মনে করেন এটা ছদ্মনাম। এই সিদ্ধ যোগীর সঙ্গে সর্বদা কুকুর থাকত বলে এমন নাম) এমন চর্যা গাইলেন যে কোটি তে একজন সমঝদার হলেন । যে বউটি দিনে কাক কে দেখে ভয় পায়, রাতে সে ই কাম নগরে যাত্রা করে । অর্থৎ ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ যোগ সাধনায় অসীম ভয় কে লঙ্ঘন করতে পারে । " দুলি দুহি পিঠা ধরন না জাই.. দুলি মানে কচ্ছপ, তাকে দুইয়ে পাত্রে ধরা যাচ্ছে না।  এ বড়ই অদ্ভূত কথা। কচ্ছপকে দোহন করা কি সম্ভব ? আসলে এটি রূপক। মুনিদত্ত এই ভাষাকে ' সান্ধ্য ভাষা ' বলেছেন। এক্ষেত্রে দুলি বা কচ্ছপ হল অপরিশুদ্ধ বোধিচিত্ত। পিঠা হল দেহপাত্র।    কাহ্নপাদ বলেছেন - " ভনই কাহ্ন দুল্লক্খ সুরবগাহ কো মনে পরিভাবই ..  -- দুর্লক্ষ্য তত্ত্বকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করতে হবে।   চিত্তের যে অবস্থায় নির্বাণ লাভের আকাঙ্খা হয় তাকে 'বোধিচিত্ত' বলে। হিন্দু যোগসাধনায় যা 'কুলকুন্ডলিনী শক্তি', সহজসাধনা-য় তার ...

চর্যা 4

চর্যা  4   চর্যাপদের উপলব্ধির জন্য বৌদ্ধ সাধন পদ্ধতিগুলি উপলব্ধির প্রয়োজন । এই পদ্ধতিগুলি 'যান বা পথ । বুদ্ধ প্রচারিত ধর্ম নিয়ে বৌদ্ধ দের মধ্যে বিরোধ না থাকলেও তার নির্বাণ লাভের পদ্ধতি নিয়ে মত পার্থক্য হয়ে ক্রমশই হীনযান, মহাযান, বজ্র যান, সহজ যান ইত্যাদি সাধন পথের উদ্ভব ।    বৌদ্ধ দের মতপার্থক্য দূর করতে রাজগৃহে, বৈশালী, পাটলিপুত্র( অশোকের সময়) এবং কনিষ্কের সময় সবমিলিয়ে চারটি মহা সম্ম লন অনুষ্ঠিত হয় । একেকটা সম্মেলনের পরে একেকটা 'যান' এর উদ্ভব হয় ।   হীনযান  -      এদের বিশ্বাস বুদ্ধ প্রদর্শিত পথেই অর্হৎ বা নির্বাণ লাভ সম্ভব । এই অর্হৎ লাভের চারটি স্তর । 1. স্রোতাপন্ন - এ অবস্থায় পশু জন্মের ভয় দূর হয় । 2. সকৃদাগামী - আর একটি মাত্র জন্ম বাকি । 3. অনাগামী - আর জন্ম নয় । 4. অর্হৎ মহা যান - নিজের নির্বাণ লাভের পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বের মুক্তি ভাবনা করা হয় । এর দুটি ভাগ 1. মাধ্যমিক - প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি র মাঝে মধ্য পথ ( শূন্য বাদ ) 2. যোগাচার -   এই যো গা চার পালন করতে গিয়ে তিনটি পৃথক পথ সৃষ্টি হয়েছিল । 1। বজ্র যান 2। কাল চক্র যা...

চর্যা 3

চর্যা 3   ' অপণা মাংসে  হরিণা  বৈরী   ... ' কাহে রে ঘেণি মেলি অচ্ছহ কীস ... ' এ বন চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো  ... ভুসুক পাদ বলছেন - হরিণ তার মাংসের জন্য নিজেই নিজের শত্রু । তার মাংসের জন্য ব্যাধ এবং  অন্য মাংসাশী প্রাণীরা তাকে তাড়া করে ফেরে । ভুসুক পাদ বলছেন, কি ছেড়ে কি নিয়ে এ জঙ্গলে পড়ে আছ । এ বন ছেড়ে অন্য বনে যাও ।   সংসার চক্রে পিষ্ট মানুষদের প্রতি এ আহ্বান । তোমার থেকে যা পাওয়া যাবে তা চেয়ে -ছিনিয়ে নিতে অন্যরা ব্যস্ত, তাতে তোমার সর্বস্ব চলে গেলেও কারো ভ্রুক্ষেপ নেই । ভুসুকপাদ তাই বলছেন, এ সংসার জঙ্গল থেকে অন্যত্র যাও । সংসার ত্যাগ নয়,  সংসারের চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে যাও । বোধিচর্যাবতার বলছে - 'অস্থিপঞ্চরতো মাংসং প্রজ্ঞাশাত্রেণ মোচয় ... কিমত্র সারমস্তীতি স্বময়েব বিচারয় ... -- নিজবুদ্ধি দ্বারা প্রজ্ঞার মাধ্যমে অস্থিপঞ্জর থেকে মাংসকে পৃথক করে দেখ কি সারপদার্থ আছে । নিজেই বিচার কর । ক্রমশ ---

চর্যা 2

   কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল    চঞ্চল চীএ পইঠো কাল ।    সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই     সুখ দুখেতে নিচিত মরিঅই ।   ভনই লুই আমহে ঝানে দিঠা... ---- শরীর হল বৃক্ষ, পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে পাঁচটি ডাল ধরা হয়েছে । চঞ্চল চিত্ত মাঝে প্রবেশ করতে হবে । সুখ দুঃখের পরে মৃত্যু অনিবার্য । তাই সকল সমাধি কি সাহায্য করতে পারে?  লুইপাদ বলছেন তিনি ধ্যানে বসে জেনেছেন ।     চর্যাপদের জন্ম ও ব্যবহার মূলত বাংলায় পাল রাজাদের সমসাময়িক । এর ভাষা প্রাকৃত বাংলা । লুইপাদ বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক। মুনি দত্তের ভাষায় আদি সিদ্ধাচার্য । তিনি বাংলা ভাষার আদিতম কবি । যোগ তন্ত্রের নানা গ্রন্থে ওনার নাম পাওয়া যায় । কোথাও কোথাও লুইপাদ কে নাথ সম্প্রদায়ের সিদ্ধ গুরু মীননাথ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে । এই বিষয়ে বিতর্ক আছে । তবে উনি ধর্মপালের সমসাময়িক । 50 টি বিখ্যাত চর্যাপদের 2 টি ওনার রচিত ।     সহজ সাধনা হল মধ্য মার্গের সাধনা । কঠোর কৃচ্ছসাধন ও উদ্দাম উপভোগের মধ্যবর্তী জীবন যাপন পথে এর গমন ।      মুনি দত্ত একে বলেছেন 'মহারাগনয়'। বৌদ্ধ সহজ সাধনার এই 'মহারাগনয় চর্...

চর্যা 1

চর্যা --  1 রাগেণ বধ্যতে লোকো রাগেণৈব বিমুচ্যতে ... ------   শ্রীহেবজ্র attachment এই বন্ধন এবং তাতেই মুক্তি । চর্যা' ব্যাখ্যাকার মুনি দত্ত -র উদ্ধৃতি । কোথাও যেন প্রবৃত্তি - র পথে নিবৃত্তি -র ইঙ্গিত ।  'চর্যাপদ  হীনযান, মহাযান  পথ পেরিয়ে বৌদ্ধ বজ্র যান ও সহজযান  সাধন পথের কথা বলে । শ্রীহেবজ্র  হল  বৌদ্ধ তন্ত্র বিষয়ক পুঁথি । চর্যাপদের মুনি দত্ত কৃত সংস্কৃত ব্যাখ্যা  হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে উদ্ধার করেন  1906  সালে ।

কঠোপনিষদ ২০

তৃতীয় বল্লী সূত্র ১৪ -১৭  ১৪। ' উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত         ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা  ...'    স্বামী বিবেকানন্দ এই মন্ত্রটি এযুগে বিখ্যাত করেছেন। তিনি বললেন, যমদেব-এরই কথা, 'ওঠো, জাগো। বরনীয় জ্ঞানীদের কাছে গিয়ে জ্ঞানপ্রাপ্ত হও। এই পথ অতি দুর্গম, ক্ষুরের ধারের মতো তীক্ষ্ণ, দুরতিক্রম্য। জ্ঞানী গণ এমনই বলে থাকেন।      উপনিষদের এই মন্ত্রটির যে অনুবাদ প্রচলিত আছে, সেটির সম্পর্কে একটু আলোচনা করে নিতে হবে। বলা হল, ওঠো এবং জাগো। এখন প্রশ্ন হল দুট,   ১। কোথা থেকে উঠবে ? কোথা থেকে জাগবে ? এবং   ২। আগে উঠবে, পরে জাগবে ? তা কি হয়  ?   আমরা বলব,   ১। অবিদ্যাতে সম্পৃক্ত জীবাত্মা যেন মোহনিদ্রায় আছে । সেখান থেকে উঠবে । অজ্ঞান নিদ্রা থেকে জাগ্রত হবে ।   ২। নিদ্রা ভাঙ্গলেও কতক সময় ঘোর লেগে থাকে। অনেক সময় পুনরায় নিদ্রা এসে যায়। তাই যমরাজ বলছেন, ওঠো এবং সজাগ হও। আর যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ো না।       ' বরান্‌ ' -এই শব্দটির অর্থ নিয়েও আমাদের কিছু কথা আছে। বলা হচ্ছে 'বরনীয় জ্ঞানীদের কাছ...

কঠোপনিশদ ১৯

তৃতীয় বল্লী সূত্র ৩ - ১৩ যমদেব সম্পূর্ন বিষয়টি বোঝানোর জন্য বলে চললেন, ৩। শরীর রথ, আত্মা রথী, বুদ্ধি সারথী এবং মন হল লাগাম।   --- সহজ কথা। মন বেলাগাম হলেই মুশকিল। ৪। সেই রথে ইন্দ্রিয়াদি গন্তব্য পথ, শরীরে যুক্ত মন হল ভোক্তা। ৫। উচ্ছৃংখল অশ্ব হলে রথের যা হয়, বিক্ষিপ্ত মনের ফলে ইন্দ্রিয় অ-বশীভূত। ৬। সংযত মন, সুসংযত অশ্বের ন্যায় বশীভূত। ৭। অসংযত মন পরমপদ লাভে অসমর্থ। তারা জীবন-মৃত্যুর পথে ভ্রনণশীল। ৮। বিবেকবান সংযত রথী ব্রহ্মপদ পান। সেখানে পৌছলে জন্ম হয় না আর। ৯। প্রায় ঐ ১০। ইন্দ্রিয় হতে মন, মন হতে বুদ্ধি, বুদ্ধি হতে আত্মা শ্রেষ্ঠ। ১১। আত্মা হতে অব্যক্ত প্রকৃতি, প্রকৃতি হতে পরম পুরুষ বা পরমাত্মা শ্রেষ্ঠ। --- এই 'অব্যক্ত' হল জীবাত্মা ও পরমাত্মা-র মধ্যবর্তী তে অবস্থিত। এক মায়াস্বরূপ আচ্ছাদন। গীতায় একে (৭/১৪) 'দুরত্যয়' বা অতি দুস্তর বলেছেন। এতে মুগ্ধ হয়ে জীব পরমাত্মাকে ভুলে থাকে ( গীতা- ৭/১৩)। একে কেউ 'মায়া', আবার কোনও কোনও অনুবাদক 'প্রকৃতি' বলেছেন।    সাংখ্য দর্শন মতে জীবাত্মা হল 'পুরুষ' এবং 'প্রকৃতি' হল এই মায়া।      কঠ উপনিষদে...

কঠোপনিষদ ১৮

প্রথম অধ্যায়, তৃতীয় বল্লী ২। 'নাচিকেত অগ্নি যজ্ঞ'কে যমদেব আর একবার বিশেষ স্থান দিলেন। বললেন, যারা যজ্ঞ করেন, তারা ভব-সমুদ্র পার হবার সেতু স্বরূপ নাচিকেত যজ্ঞকে জেনে অক্ষরকে পরম ব্রহ্ম জেনেছেন।   -- পরম ব্রহ্মকে জানার মধ্যবর্তী মধ্যবর্তী স্তর হল 'নাচিকেত অগ্নি বিদ্যা'। এই বিদ্যা দেবতারা জানতেন। যম দ্বিতীয় বরে নচিকেতাকে এই বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। এই বিদ্যা অভ্যাস করলে ষড় রিপু এবং অষ্টপাশ মুক্ত হওয়া যায়। এসব থেকে মুক্ত না হলে আত্মজ্ঞান সম্ভব নয়।    এখন প্রশ্ন হল, এই 'নাচিকেত অগ্নিবিদ্যা' জানা না থাকলে সাধকের কি আর কোন উপায় নেই ?   বিষয়টি আসলে এরকম নয়। দেবলোকের দেবতারা 'নাচিকেত অগ্নিবিদ্যা' নামক সাধন পদ্ধতি আবিস্কার করেছিলেন এসব রিপু ও পাশ মুক্ত হবার জন্য। ঐ সাধন পদ্ধতিতে দেবতারা ঐ স্তরে পৌছতে পারতেন।     অনন্ত বিশ্বে রয়েছে অনন্ত সম্ভাবনা। 'নাচিকেত অগ্নিবিদ্যা' একমাত্র পথ নয়। উপনিষদের যুগে দেবতাদের থেকে শিখে মর্ত্যলোকের ঋষি-মুনিরা ওই অগ্নিবিদ্যা চর্চা করতেন। আরও নানা করনে নানা অগ্নিবিদ্যার চর্চা যে হত তার নামও আমরা পাই উপনিষদ চর্চাতে। পরবর্তীকাল...

কঠোপনিষদ ১৭

প্রথম অধ্যায়, তৃতীয় বল্লী : সূত্র ১।   সুকৃতির ফলে লোকে পরম ব্রহ্মের গহণ নিবাসস্থলে 'ঋত'-কে পান করে। ব্রহ্মবিদরাও একথা বলেন। ত্রিনাচিকেত এবং পঞ্চ-অগ্নি যজ্ঞকারীরাও একথা বলেন। --- এর আগে যমদেব জানিয়েছেন, যাকে তিনি (পর ব্রহ্ম ) স্বরূপ বিবৃত করবেন, কেবল তিনিই জানতে পারবেন। এখন প্রশ্ন হল, কাকে এই স্বরূপ বিবৃত করা হবে ? এটা কি পর-ব্রহ্ম  abruptly খেয়ালখুশিমত করবেন ?    এবার যমদেব বললেন, সুকৃতির ফলেই এই 'ঋত' বা সত্য-কে পান করা বা লাভ করা সম্ভব। যম জানালেন, এটা শুধু তার নিজের কথা নয়, ব্রহ্মবিদ ও যজ্ঞকারী ব্যক্তিরাও একথা বলেন।   'পরমে পরার্ধে ' ---   পরার্ধ = পর + অর্ধ (স্থান)             = ব্রহ্মের স্থান             = এস্থলে হৃদয়াকাশ ' ঋতম পিবন্তৌ '    'পিবন্তৌ' এই দ্বিবিচনটির প্রয়োগ টি বিবেচনাযোগ্য। হঠাত্‌ দ্বিবচন হল কেন ?    এভাবে কি ভাবতে পারি যে, জীবাত্মা যখন আত্মজ্ঞান লাভ করে, তখন জীবাত্মা ও পরমাত্মা একত্রে এই সত্যকে পান করে। সেই জীবনসুধা পান করার জন্য তখন জীবাত্মা-পরম...

কঠোপনিষদ 16

সূত্র  22 - 25  22। যমদেব জানালেন, অনিত্য ( বিনাশশীল ) শরীরে মহান নিত্য আত্মাকে সাক্ষাত করে ধীর ব্যক্তি শোকরহিত থাকেন ।  -- ধীর ব্যক্তিই জ্ঞান লাভ করেন । ধীর ব্যক্তি ই বোঝেন এই শরীরই সব নয় । সে তাই পার্থিব বিষয়ের অনিত্য তা অনুভব করে । 23। 'নায়মাত্মা প্রবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন'      যাকে তিনি জানান বা বিবৃত করেন, তার কাছেই এই আত্মা স্বীয় রূপ প্রকাশ করে ।    তাকে প্রবচন শুনে জানা যাবে না, মেধা দিয়ে বোঝা যাবে না । এমনকি বারবার শুনেও অনুধাবন করা সম্ভব নয়।   এখানে এক সমস্যা এসে দাঁড়ালো । শুনে বা বুদ্ধি দিয়ে সেই আত্মা কে বোঝা যাবে না । তাহলে  পরমাত্মার দয়ার ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে ? আবার পরমাত্মা abruptly যার কাছে খুশি ধরা দেবেন  ? এরকম কি হয়  ?      এর উত্তর তৃতীয় বল্লীতে আছে । সুকৃতির ফলে পাওয়া যাবে । 24। যম বলে চলেছেন, দুষ্কর্ম থেকে বিরত না হলে পাওয়া যাবে না । অশান্ত ব্যক্তি, অসমাহিত ব্যক্তির এই প্রজ্ঞা হয় না । মন শান্ত না হলেও লাভ হবে না । 25। খানিকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ব্রাহ্মণ হোক বা ক্ষত...

কঠোপনিষদ ১৫

সূত্র  ১৮  'ন জায়তে ম্রিয়তে ...... ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে '  আত্মা জন্মায় না, মরে না। না এটি কারো থেকে উদ্ভূত হয়েছে, না এর থেকে কিছু হয়েছে। ইনি অজাত, নিত্য, শাশ্বতঃ। শরীরের নাশ হলেও, এর নাশ হয় না। ----  বহু চর্চিত এই শ্লোক। এর দ্বিতীয় লাইনটি গীতাতে হুবহু রয়েছে ( ২/২০)। বহু আলোচিত এও আত্মার সংজ্ঞা নিয়ে আর বিশেষ কিছু বলার নেই। ১৯। যদি হত্যাকারী মনে করে হত্যা করলাম, নিহিত যদি মনে করে হত হলাম, তাহলে দুজনেই ভুল জানেন। এই আত্মা কাউকে মারেও না, কারো দ্বারা হতও হন না। --- এই দুই শ্লোকে বলা হল, আত্মা আমাদের শরীরের থেকে পৃথক।  একই কথা গীতাতে বলা আছে,      ' য এনং বেত্তি ......       ......... ন হন্যতে ।'   এখানেও দ্বিতীয় লাইনটি গীতাতে হুবহু এক। ২০। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর এবং মহত্‌ থেকে মহত্তর আত্মা সমস্ত প্রাণীর হৃদয়-গুহায় অবস্থিত। কামনারহিত এবং বীতশোক হলে আত্মার এই স্বরূপকে দর্শন করা যায়।   এখানে 'ধাতু প্রাসাদাত' = ধাতা বা ঈশ্বারের অনুগ্রহে। ২১।  এই আত্মা বসে থেকেই দূরে যায়, শুয়ে থেকেই সর্বত্র যায়। যম বলছেন, তাদ...

কঠোপনিষদ ১৪

সূত্র  ১৫ -   ১৫।   যম বললেন, সকল বেদ যে পরম পদের কথা বলে, সকল তপস্যা যার কথা বলে, যার কারনে (যে পদ লাভের ইচ্ছায়) ব্রহ্মচর্য পালন করা হয়, সেই পদের কথা বলছি। সেটি হল ওঁ ।   --- একটু পরেই যম, ওঁ তথা অক্ষর তত্ত্বের কথা বলবেন।   ওঁ-কে দুভাবে বিচার করা হয়।      ১। ওঁ -ই হল ব্রহ্ম । এবং/অথবা      ২। ওঁ হল ব্রহ্মের প্রতীক । যেমন শালগ্রামশিলা বিষ্ণুর প্রতীক।   যে ব্রহ্মচর্য পালনের কথা বলা হল, তার আবার তিনটি অর্থ -     ১। ইন্দ্রিয় সংযম। এর ব্যাখ্যা করার বিশেষ প্রয়োজন নেই।     ২। গুরুগৃহে শিক্ষার্থে বাস।  চতুরাশ্রমের প্রথম টি  হল ব্রহ্মচর্য। ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথে গুরু দিশা দেবেন - এই কারনেই এর এমন নাম।    ৩। ব্রহ্মে বিচরণ করা। ব্যাকরণগতভাবে এটাই প্রকৃত অর্থ।   প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মচর্য পালন করার অর্থ হল 'ব্রহ্মে বিচরণ করা'। ব্রহ্মে যিনি বচরণ করেন বা বিচরণ করার প্রয়াস করেন তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার এমনিই কমে যায়।  ব্রহ্মচারী মানে যিনি পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে একমুখী করে পরম ব্রহ্মের চিন্ত...

কঠোপনিষদ ১৩

    যম বা যমদেব নিয়ে দু’একটি কথা এখানে আলোচনা করে নিই আমরা ।     দেবলোক বা ভৌম-স্বর্গ সুমেরু পাহাড়ে অবস্থিত। এই সুমেরু বর্তমানের north pole নয় । এর আট দিকে আট দিকপালের অবস্থান। যেমন -   - পূর্ব দিকে - ইন্দ্রের  = অমরাবতী  - ঈশান বা উত্তর পূর্ব - শিব = যশোবতী  - দক্ষিণ পূর্ব  - অগ্নি = তেজবতী  - দক্ষিণ - যম = সংযমনী।    ইত্যাদি  ( বিষ্ণু পুরাণ,  দেবী ভাগবতী etc)    এখন যম কথার অর্থ নিবৃত্ত করা বা হওয়া । পাতঞ্জল যোগ অনুযায়ী অষ্টাঙ্গ সাধনার প্রথমটি হল 'যম'।   'শরীর সাধনপিক্ষম নিত্যং যত্কর্ম তদ্যম'।    শাস্ত্রে দশ রকম quality কে যম বলে ।  যেমন- "ব্রহ্মচর্য দয়া ক্ষান্তির্দান সত্যমকলল্কতা অহিংসাস্তেযমাধুর্য দমশ্চ্রেতি যমাঃ স্মৃতাঃ ।"     এসব quality দেবলোকে যার আছে তিনি স্বর্গে যম পদের যোগ্য । তার পুরীর নাম 'সংযমনী '। নাম থেকেই সংযমের কথা মনে পড়ে । এই নগরে 'যম'-এর আরাধনা হয় । এই লোকের অধিকর্তা তাই 'যমরাজ '। তিনিই ধর্মরাজ ।  সূত্র ১২ - ১২। ধীর ব্যাক্তি গূঢ় গহণ গুহায়...

কঠোপনিষদ ১২

  যমদেব নিয়ে দু’একটি কথা বলা আবশ্যকীয় হয়ে পড়ছে । 'যম' কথাটির অর্থ   restraining or controlling. পতঞ্জলি যোগানুযায়ী অষ্টাঙ্গ সাধনার প্রথমটি হল যম।   আবার হিমাচলের লাহুল-স্পিতি অঞ্চলে 'যমলু' বলে জায়গা আছে । কীরাত জাতির লোকদের বাস ছিল । তাদের ভাষায় 'যমলোক' কে 'যমলু' বলা হয়েছে বলে মত দিয়েছেন কেউ কেউ ।    যমের পুরীর নাম 'সংযমনী'। এই নামের মধ্যে সংযম কথাটি আছে ।    তাহলে যম কি একটা concept  ?  নাকি এই নামে পদ ছিল  ? সূত্র ৮- ১১   ৮ নং সূত্রে আরো বলা হল যে,    'অনীয়াণ্‌ হ্যতর্ক্যম্নুপ্রমাণাত্‌ ' = হি অনুপ্রমাণাত্‌ অতর্কম্‌ অনীয়াণ,  - এই সূক্ষ্য জ্ঞান তর্কের অতীত। অর্থাত্‌ কেবলমাত্র তর্ক দ্বারা জানা সম্ভব নয়।   এখানে অনেকেই আপত্তি করতে পারেন। আসলে বলা হয়, আত্‌মজ্ঞান অনুভবের বিষয়। বুদ্ধির দ্বারা এর কূলকিনারা পাওয়া সম্ভব নয়।     ৯। এই সূত্রেও একই কথা বলা হল।   ১০। যমদেব বলছেন, কর্ম ফল অনিত্য। অধ্রূব বা অনিত্য বস্তু দিয়ে ধ্রুব বা নিত্য সত্যকে লাভ করা যায় না। তাই তিনি নিজে অনিত্য বস্তু দিয়ে 'অগ্নি...

কঠোপনিষদ ১১

 সূত্র  ৫- ৮  ৫। যমদেব বললেন, যারা অবিদ্যার মধ্যে অবস্থান করে নিজেকে ধীর বা বুদ্ধিমান মনে করে তারা হলেন মূঢ বা মূর্খ। এরা অন্ধের মতো সংসারে পরিভ্রমণ করে।   ৬।  ধনাদি মোহে প্রমাদী বা অজ্ঞানী লোক মনে করে, 'অয়ং লোকো নাস্তি পর', এই জগতই সত্য, পরলোক বলে কিছু নেই। এরা বারবার জন্মমৃত্যুর বশে থাকে।  --- অর্থাত্‌ আত্‌মজ্ঞান না হলে বারবার জন্ম-মৃত্যু চলতে থাকে। আত্‌মজ্ঞানী-ই কেবল এই জগতের বাইরে পরলোকের বিষয়ে অনুধাবন করতে পারে।   ৭। এই আত্‌মজ্ঞান বহুজনের শোনার জন্য লভ্য নয়, শুনলেও বহুলোকের বোধগম্য নয়। কেবল কুশলী জ্ঞানীর কাছ থেকে কুশল ব্যাক্তিই একে লাভ করতে পারে।   ---  এ তো আমরা জানি। সত্য বা জ্ঞান সকলের জন্য নয়। সকলে একে কানে তোলে না। যদি বা শুনতে পায়ও এর অর্থ অনুধাবন করতে পারে না। দ্রোণ সকলকেই অস্ত্রশিক্ষা দিলেও অর্জুন সবাই হয় না।    এই আত্‌মজ্ঞান সকলে জানতে পারে না। জানতে পারলেও বুঝতে পারে না। জানতে-বুঝতে পারলেও সবাই এ জ্ঞান প্রকাশ করতে পারে না।  ৮। 'অবরেণ নরেণ প্রোক্ত'।       অযোগ্য/অল্পজ্ঞানী লোক দ্বারা বলা হল...

কঠোপনিষদ ১০

সূত্র  ১/২/২-৪     ২।  যমদেব বলে চললেন,  শ্রেয় এবং প্রেয় দুই-ই মানুষের সামনে আসে। ধীর ব্যক্তি বিচারপূর্বক প্রেয় অপেক্ষা শ্রেয়কে শ্রেষ্ঠ মনে করে বরণ করে নেয়।     মন্দবুদ্ধির ব্যক্তি 'যোগক্ষেমাত্‌ ( অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি-কে এক অর্থে যোগ বলে এবং প্রাপ্তবস্তুর রক্ষাকে ক্ষেম বলে)' প্রেয়কে বরণ করে নেয়।     ---  যার বুদ্ধি ধীর নয় সে নিজ পরিশ্রম ছাড়া বা অল্প পরিশ্রমে যা লাভ করে তার পেছনে বিগত জন্মের কর্ম রয়েছে সেটি অনুধাবন করতে পারে না। ফলে এটি তার প্রাপ্য বলেই ধরে নায়। কর্মের ফল যতটুকু তার পরেই যে এ সব প্রাপ্তির অবসান ঘটবে সেটিও তারা বুঝতে পারে না। ফলে সেই প্রাপ্তিকে রক্ষা করার জন্য পরিশ্রম করে।      ধীর বা জ্ঞানী এই প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে যা কল্যাণকর পথ সেটাকেই গ্রহণ করে নিয়ে এগিয়ে যায়।   ৩। যমদেব প্রশংসাপূর্বক বললেন, যে সকল কামনাতে বহুমানুষ মযে যায়, নচিকেতা বিচারপুর্বক সেসব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে।    ---  এ কারনেই নচিকেতা  আত্মজ্ঞান লাভের অধিকারী।   ৪ ।  সাধনা ...

কঠোপনিষদ ৯

প্রথম অধ্যায় - দ্বিতীয় বল্লী ।    সূত্র - ১      তৃতীয় বর তথা আত্মজ্ঞান প্রদানে উদ্দত যমদেব নচিকেতাকে বললেন, পথ দুটি; শ্রেয়ঃ এবং প্রেয়ঃ। উভয় পথের ফল ভিন্ন। তবে উভয় পথই বন্ধনে আবদ্ধ করে। যে ব্যাক্তি শ্রেয়ঃ বা কল্যাণকর পথ গ্রহণ করে তার মঙ্গল হয়। যে প্রেয়ঃ বা প্রিয়জনক পথ গ্রহণ করে সে যথার্থ লাভ থেকে ভ্রষ্ট হয়।     শত শত বছর ধরে বহু আলোচনা হয়েছে, এই উপনিষদের শ্রেয়ঃ এবং প্রেয়ঃ -কে নিয়ে। নানা পন্ডিত নানা দিক উল্লেখ করেছেন।      আমরা সাধারন মানুষ সবসময় বুঝতে পারি না কিসে আমাদের মঙ্গল। যা আমাদের কাছে পছন্দের বা প্রিয়, তাকে প্রেয়ঃ বলে। আর যাতে আখেরে আমার মঙ্গল, সেটি হল শ্রেয়ঃ।      বিশেষভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে, যে পথ মুক্তির দিকে নিয়ে যায় সেটি হল শ্রেয়। আর যে পথ ইহলোকের ভোগের দিকে নিয়ে যায়, সেটি হল প্রেয় পথ।     কেউ কেউ বলেছেন, সাধনার দুটি পথ। একটি পার্থিব যশ, ঐশর্যাদি লাভের। এটি প্রেয় পথ। অপরটি মুক্তি বা মোক্ষের পথ।    কিন্তু এই কথাটায় এসে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, যে উভয় পথ-ই বন্ধনের কারন। উভয়ই যদি বন্ধনের কারন হ...

কঠোপনিষদ 8

সূত্র  --29   নচিকেতার এহেন বর প্রার্থনায় যমদেব প্রথমে রাজি হলেন না ।  তিনি বিনিময়ে সকল পার্থিব সুখ দিতে চাইলেন । যম একে একে offer করলেন - 1 । শতায়ু 2 । পুত্র - পৌত্র 3 । প্রচুর গবাদি পশু 4 । স্বর্ণ - হাতি 5 । অশ্ব 6 । বিস্তীর্ণ ভূমি 7 । সুসজ্জিত রথ 8 । অপ্সরা   এই যে list এর প্রথম দুটি বাদ দিয়ে সবই একজন রাজা দিতে পারেন । প্রাচীন কালে নৃপতিরাই এসব দিতেন । যমরাজ যমলোকের রাজা। তাই এসব সম্পদ তার আছে এবং আশ্রিতকে দান করতে পারেন ।   শতায়ু প্রসঙ্গে বলা যায় প্রায় সকলেই সে যুগে দীর্ঘজীবী । অসময়ে অপঘাত মৃত্যু বিরল ঘটনা । ক্ষত্রিয়রা যুদ্ধ-বিগ্রহে হত হলেও ব্রাহ্মণরা অবধ্য। যমলোকে তথা মৃত্যুলোকে এসে পড়লে অপঘাতে মৃত্যুর  সম্ভাবনা থাকে । এক্ষেত্রে স্বয়ং যমরাজ অভয় দিচ্ছেন। এবং 'ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা' না থাকলে পুত্র -পৌত্র হওয়াই স্বাভাবিক ।    কিন্তু নচিকেতা এসব নিতে অস্বীকার করলেন ।     নচিকেতা জানালেন, তিনি এসব চান না। তার কারন স্বরূপ বললেন [ ২৬ -২৯]; ১। জীবনকাল সংক্ষিপ্ত । ২। এসব ভোগ্য পদার্থ মানুষের ইন্দ্রিয়ের তেজকে হ্রাস করে। ৩। সম্পত্...

কঠোপনিষদ 7

সূত্র  20 - 25   যমদেব, গোপন সাধন পদ্ধতি লৌকিক ভাবেই, একজন গুরু যেমন শিষ্যকে শিক্ষা দেন সেভাবেই শেখালেন । শিষ্যের উৎকর্ষতা দেখে পার্থিব উপহারও দিলেন ।   জানা গেল এই অগ্নিবিদ্যার চর্চায় শোক-তাপ-মৃত্যুভয় রহিত হওয়া যায় । স্বর্গলোকের বাসিন্দারা এসব চর্চা করেই জরা-ব্যাধিহীন আনন্দময় জীবন যাপন করেন। এই বিদ্যা এতোদিন গোপন ছিল । যমদেবের থেকে শিক্ষা নিয়ে নচিকেতা, এটি মানব গোষ্ঠীতে প্রচলন করবেন । 'নাচিকেত অগ্নিবিদ্যা' নামে এটি খ্যাত হবে।    মনে রাখতে হবে শুধু বাহ্যিক উপাচার পালনে যজ্ঞ কার্য সম্পূর্ণ হয় না । ফলে আজকাল যজ্ঞাদি ক্রিয়াতে ফললাভ ও হয় না । মন্ত্রাদি, শ্বাস ক্রিয়া সঠিকভাবে পালনীয় ।     কঠোপিষদ আলোচনায় সর্বত্র তৃতীয় বর অর্থাত্‌ আত্মতত্ত্ব নিয়েই আলোচনা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বরটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যমদেব স্বীকার করেছেন এই অগ্নিবিদ্যা চর্চা করেই দেবতারা দেবতা হয়েছেন। এর প্রকৃত চর্চা বা সাধনার দ্বারাই চিত্ত-বৃত্তিতে control আসে। ষড় রিপু এবং অষ্টপাশ থেকে মুক্ত হবার উপায় আছে এই অগ্নি বিদ্যায়। এই উপাসনায় যিনি সাফল্য লাভ করেছেন তিনি আত্মতত্ত্ব জানবার অধিকারী...

কঠোপনিষদ 6

    দেবতাদের মানবদেহধারী বর্ণনায় একজন স্নেহ ভাজন  কিছু যথাযথ প্রশ্ন তুলেছেন । সংক্ষেপে এখানে জানাই ঋক বেদে বারংবার দেবতাদের নর বা মানুষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । যেমন - 1।   1/30/9 = ইন্দ্রকে 'নরম্' 2।   4/17/11 = ইন্দ্রকে 'নৃতম্' 3।   3/1/12 = অগ্নিকে 'নৃতম্ ' 4।   3/52/8 = ইন্দ্র শ্রেষ্ঠ মানববীর (বীরতমায়নৃণাম) 5।   5/4/6 = অগ্নি নরপতি  ( নৃণাং নৃপতে)।       এছাড়াও বেশ কিছু সূত্রে দেবতাদের হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনা আছে । 6।  1/20/1 = এই ঋকের ভাষ্যে সায়ণাচার্য বলেন, ঋভুরা আগে মানুষ ছিলেন,  পরে তপস্যা করে  দেবত্ব লাভ করেন।    ছান্দোগ্য উপনিষদে  (1/4/2) বলা আছে, দেবতারা মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়েছিলেন ।    (বিস্তারিত আলোচনা   page 175 - আর্য দিগন্তে সিন্ধু সভ্যতা )     আধাত্ম্য স্বর্গ,  ভৌম স্বর্গ  এক নয় । পারলৌকিক স্বর্গ থাকতে পারে । তবে দেবগোষ্ঠীর লোকেরা পার্বত্য অঞ্চলে 'ভৌম স্বর্গ ' গড়ে তুলেছিলেন । নাম থেকেই বোঝা যায় এটি ভূ-জগতে অবস্থিত।   ...

কঠোপনিষদ 5

  সূত্র - 10 - 13  'শান্তসংকল্পঃ / যথা / স্বর্গে লোকে / স ত্বমগ্নি '    নচিকেতা প্রথম বর চাইলেন, তার পিতা যেন তার বিষয়ে দুশ্চিন্তাহীন এবং তার প্রতি প্রসন্নমনা ও ক্রোধরহিত থাকেন  ( এভাবে চলে আসাতে )। এবং এখান থেকে পিতৃগৃহে ফিরে যাবার পর পিতা যেন পূর্বের মতোই ব্যবহার করেন  ( কথা বলেন )।    এ অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রার্থনা । যে পথে যেতে গিয়ে যুধিষ্ঠির ছাড়া দ্রৌপদীসহ বাকি চার পান্ডব মারা যান, সে পথ অবশ্যই দুর্গম । হঠাৎই চলে আসায় পিতার দুশ্চিন্তা হবেই । আর দুশ্চিন্তা মুক্ত হলে আসবে অভিমান ও ক্রোধ । যে বাড়িতে ডাকাবুকো ছেলে থাকে,  তারা এই emotion টি বুঝতে পারবেন ।    নচিকেতা বালক হলেও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন ও চিন্তাশীল । পিতার কথা যে মনের কথা ছিল না সে সেটা জানে। তবে পিতার কথাকে positively নিয়ে সে জীবন ঝুঁকি নিয়ে যমলোকে চলে এসেছে । এর আগে বিশ্বজিৎ যজ্ঞে পিতা সর্বস্ব দানের নামে রোগা-ভোগা ও মৃতপ্রায় গবাদি পশু দান দেখে সে হতাশ হয়েছিল । পিতার সংকীর্ণতা তাকে আহত করেছিল । এই পিতার কাছে প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞান লাভ সম্ভব নয়,  সেটাও বোধকরি বুঝেছিল ।...

কঠোপনিষদ ৪

  সূত্র ২-৬ ' তং হ তুমারং / পীতোদকা/ /স হোবাচ /বহূনামেমি/  আনুপশ্য ...।    বিশ্বজিত্‌ যজ্ঞে যেহেতু সর্বস্ব দান করতে হয়, তাই উদ্দালক পুত্র নচিকেতা প্রশ্ন করলেন, পিতা তাকে কার কাছে দান করলেন ? বারংবার জিজ্ঞাসা করায় বিরক্ত হয়ে পিতা বললেন, তিনি নচিকেতাকে 'মৃত্যুবে' অর্থাত্‌ মৃত্যুকে [ ব্যাখ্যাকাররা 'মৃত্যু' বলতে যম ধরেছেন] দান করেছেন। নচিকেতা অনেক ভাবনা চিন্তা করে যমলোকে এসে পৌছলেন। [ বদ্রীনাথ ছাড়িয়ে মানা গ্রাম পার হয়ে স্বর্গলোকে যাবার পথ ছিল। পান্ডুবরা অন্তিমসময়ে এই পথ ধরেছিলেন 'স্বর্গারোহন পর্বে'। ভৌম স্বর্গের দ্বারস্বরূপ হল যমলোক ]। সূত্র ৭-৯  ' বৈশ্বানরঃ/ আশাপ্রতীক্ষে / তস্রো রাত্রি ...।    যমদেব সে সময় অন্যত্র ছিলেন। তিনদিন তিনরাত্রি নচিকেতা দ্বারে অপেক্ষা করলেন। যমরাজ ফিরে এসে তিন রাত্রির জন্য তিনটি বর প্রদানের অঙ্গীকার করলেন।     এখানে যমরাজ কোন অলৌকিক দেবতা নন। দেহধারী মানুষ। অন্য কাজে গেছিলেন। তিনদিন পর ফিরে জানতে পারলেন এক ব্রাহ্মণ সন্তান অনাহারে অপেক্ষায় আছেন। তিনি কোন অলৌকিক উপায়ে এ তথ্য জানতে পারেন নি। 'বর' প্রদানকে আমরা অলৌকি...

কঠোপনিষদ 3

1ম অধ্যায়/ 1ম বল্লী  (বল্লী = sub-chapter )   "ওঁ উশন হবৈ বাজশ্রবসঃ সর্ববেদসং দদৌ " । 1 নচিকেতার পিতার নানা নাম পাচ্ছি আমরা । ইনি গৌতম বংশীয় আরুণি পুত্র বাজশ্রবা উদ্দালক । 'বাজশ্রবা' কয়েক পুরুষ ধরে বংশ নাম । যেমন রামচন্দ্রের নাম 'রঘুপতি বা রাঘব'। রঘু সূর্য বংশে রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ । যেমন দুর্যোধনরা পূর্বপুরুষ 'কুরু'-র নামে 'কৌরব'। আবার পান্ডবরা আদতে কৌরব হলেও দুর্যোধনদের থেকে পৃথক identification এর জন্য পান্ডব বলে বেশি পরিচিত ।   একই রকম আমরা ঋক বেদে পাচ্ছি, দেবতারাও আদতে 'অসুর'। পরবর্তীকালে দৈত্য -দানবরা  ( দিতি ও দনুর সন্ততি; দাঁত-নোখওয়ালা monster নয়), 'অসুর' নামে পরিচিত রয়ে গেলেন। দেবতারা 'অসুর'-এর বিপরীতে হলেন 'সুর'। ভাষাবিদ সুকুমার সেন দেখিয়েছেন, 'সুর'-এর বিপরীতে অ-পূর্বক 'অসুর' শব্দের সৃষ্টি হয় নি । 'অসুর'-ই আদি শব্দ ।   'বাজ' = অন্ন , 'শ্রব' = যশ । 'বাজশ্রবা ' অর্থ 'অন্ন (দান) জনিত যশ প্রাপ্ত ব্যক্তি । ঋষি গৌতমের এক বংশধর এই নাম অর্জন করেন । বাজশ্...

কঠোপনিষদ 2

 আমরা যেভাবে আর্য সভ্যতাকে অনুধাবন করতে চেয়েছি ( আর্য দিগন্তে সিন্ধু সভ্যতা ) তাতে তথাকথিত দেবতারা সকলেই মানুষ । ভৌম স্বর্গ বলে হিমালয়ে protected স্থান আছে । তার দখল নিয়ে দেবতা ও অসুর দের মধ্যে লড়াই । সে স্থানের রাজা হলেন ইন্দ্র। হিরণ্যকশিপু, প্রহ্লাদ, বিরোচন, বলি - এনারা অসুর দের মধ্যে ইন্দ্র । পরবর্তীকালে এই পদ দেবতাদের দখলে । দেব-অসুর ছাড়া আর এক গোষ্ঠী হল তাদেরই colony  (পাতাল) এলাকাতে দায়িত্ব প্রাপ্ত মনুদের বংশ । বিখ্যাত সূর্য ও চন্দ্র বংশ । এরা মানব  (মনু থেকে )। চন্দ্র বংশের রজি এবং নহুষ ইন্দ্র পদ লাভ করেছিলেন । এই তথাকথিত আর্যরা প্রথমে পার্বত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করলেও তথাকথিত অনার্যদের সাথে লড়াই ছিলই । ক্রমশই আর্যরা ভারতের সমভূমিতে বিস্তৃত হচ্ছিল । আর ফলস্বরূপ আদি বসতি স্থান সমতলবাসীদের কাছে অগম্য হচ্ছিল । পান্ডু রাজা বনবাসকালে(বদ্রির কাছে ) লোমশ মুনিকে দলবল নিয়ে স্বর্গে যেতে দেখেছেন । তিনি যেতে চাইলেও অনুমতি নেই বলা হয় । এই স্বর্গের দক্ষিণ দিকে সমতল বলে পাহারার ব্যবস্থা হয়। দায়িত্ব যমরাজ । তার সশস্ত্র বাহিনী ও হিংস্র পাহাড়ী কুকুর আছে । অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করলে...

কঠোপনিষদ 1

  কদিন বিশ্রামান্তে আসুন একসাথে কঠোপনিষদ পাঠে প্রবেশ করা যাক । যমরাজ ও নচিকেতাকে প্রথমে প্রণাম ।  " ওঁ নমো ভগবতে বৈবস্বতায় মৃত্যবে ব্রহ্মবিদ্যাচার্যায় নচিকেতসে চ।"   - ভগবতী এবং ব্রহ্মবিদ্যার আচার্য বৈবস্বত যম এবং নচিকেতাকে প্রণাম ।   আমরা বৈবস্বত মনুর নাম শুনেছি । তাহলে যমরাজ কি করে বৈবস্বত হলেন ? পৌরাণিক দ্বাদশ আদিত্য,  কশ্যপ মুনি ও অদিতির সন্তান। দৈত্য( হিরণ্যকশিপু) ও দানব রা (মানুষ বৈকি ) তাদের বৈমাত্রেয় ভাই;  দিতি ও দনুর সন্তান । দ্বাদশ আদিত্যের একজন বিবস্বান, ইনি সূর্যদেব । এনার পুত্ররা হলেন যমরাজ , শণিদেব ও মনু । বিবস্বানের পুত্র, তাই সবাই বৈবস্বত । যিনি মনু হলেন তিনি মনু পদে সপ্তম। প্রথম মনু স্বায়ম্ভূব  (বিস্তারিত :আর্য দিগন্তে সিন্ধু সভ্যতা )।    কঠোপনিষদ কৃষ্ণ যজুর্বেদের  কঠ শাখার  অন্তর্গত। পতঞ্জলি তার মহাভাষ্যে জানিয়েছেন, যজুর্বেদের 101 টি, সামবেদের  1000 টি, ঋক বেদের  21 টি এবং অথর্ব বেদের  9 টি  শাখা  ছিল । এর অধিকাংশই আজ লুপ্ত ।  কিছু পাওয়া যায় । এমনই কৃষ্ণ যজুর্বেদের কঠ শাখার উপন...

সাংখ্য প্রবচন সূত্র 6

 সাংখ্য আলোচনার এক বিসম্বাদ ঘটে পুরুষ ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনায়। সাধারণ অবস্থায় আমরা 'পুরুষ ' অর্থে ছেলে বা male ব্যক্তি ধরে নিই, আর 'প্রকৃতি ' বলতে মহিলা । এদিকে আবার 'ছেলে ' বলতে 'ব্যাটাছেলে' বুঝি। কিন্তু তা তো নয়। 'ছা' অর্থাৎ সন্তান । এর থেকে 'ছাওয়াল ', তার থেকে 'ছেলে'। ছেলে হল উভলিঙ্গ । এর দুইভাগ । ব্যাটাছেলে ও মেয়েছেলে । Faminist রা আবার আজকাল ছেলেবেলার বিপরীত 'মেয়েবেলা' শব্দটির আমদানি করেছেন ।   যাহোক সাংখ্য বা যেকোন আধ্যাত্ম শাস্ত্রে 'পুরুষ ' হল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জীবাত্মা । আর 'প্রকৃতি' হল Mother nature.     মনে প্রশ্ন আসতে পারে, তন্ত্র সাধনায় বা বাউল -বৈষ্ণব দের মধ্যে প্রকৃতি জ্ঞানে নারীকে সাধন সঙ্গিনী করা হচ্ছে । সেখানে তো প্রকৃতি মানে নারীই হল । এই জায়গাটা আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করব ।    সাংখ্য হল ভারতের প্রাচীনতম দর্শন । সেখানে মূলতঃ চারটি বিষয় বা উপাদান  এবং তাদের ক্রিয়া -বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়ে জগতকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করা হয়েছে । সেগুলো হল- - পুরুষ -প্রকৃতি -পঞ্চভূতাদি -তন্মাত্র ।...

সাংখ্য প্রবচন সূত্র 5

  কর্মফল বিষয়টি পরিপাক যন্ত্রের যে উদাহরণ দিয়ে আমরা বুঝতে চাইলাম,সেটি অতি সরলীকরণ করা  হয়েছে । ঐ কর্মফলটি শরীর কেন্দ্রিক । ফল তাই শরীর ভোগ করে । শরীর পঞ্চভূতাদি ও চেতন শক্তি দিয়ে সৃষ্ট । জীবিত অবস্থায় জীব শরীর ও মন দুভাবেই এর ফল ভোগ করে ।     এর বাইরে এমন অনেক কাজ আমরা করি যার প্রভাব আমাদের শরীর ছাড়িয়ে পারিপার্শ্বিক অন্য প্রাণ তথা চেতন সত্ত্বার  ওপর পরে । আমার কারনে ঘটা অন্যের সুখ-দুঃখের ফল আমাদের ভুগতে হয় । যা এখন ভুগে নিলাম তো মিটেই গেল, আর যা রয়ে গেল তা হল সঞ্চিত কর্মফল । যদি এ জন্মে ভোগ হল তো ভাল কথা, না হলে জমল পরের জন্মে প্রারব্ধ হয়ে ।   " ত্রিতাপ  জ্বালা " -  সাংখ্য কারিকা-র সূত্র শুরুর আগে "লোহিত-শুক্ল-কৃষ্ণ" এই তিন বর্ণের রজঃ-সত্ত্ব-তমঃ এই ত্রিগুণের আধার প্রকৃতিকে প্রণাম করা হয়েছে । ত্রিগুণের আলোচনা আগের দিন আমরা করেছি।     এর পরই দুঃখ তিন প্রকার বলা হয়েছে । প্রবচন সূত্র শুরুই হচ্ছে "ত্রিবিধ দুঃখ নিবৃত্তিরর্থ পুরুষানাম্"  এই ত্রিবিধ দুঃখকেই ত্রিতাপ জ্বালা বলে । এদের নাম - 1। আধিদৈবিক 2। আধিভৌতিক  ও 3। আধ্যাত্...

সাংখ্য প্রবচন সূত্র 4

  আমার senior, একজন সম্মানিত ব্যক্তি ন্যয্যতঃ  বলেছেন যে বেশ কিছু শব্দের ব্যবহার করা হচ্ছে,  যাদের সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলে নিলে আলোচনাতে অধিক আগ্রহ হতে পারে । তার আদেশ শিরোধার্য করলাম । ক্ষুদ্র সামর্থ্য মতো চেষ্টা করা হল এখানে । শব্দগুলি হল -   - ত্রিকাল   - ত্রিতাপ   - ত্রিগুণ   - প্রারব্ধ  ইত্যাদি ।    সাধারণ বুদ্ধিতে আমরা জানি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত এই হল তিন কাল। আজ যে সময়ে আছি সেটি বর্তমান, যে সময় চলে গিয়েছে সেটি অতীত এবং যে সময় আসবে সেটি হল ভবিষ্যত কাল। যিনি এই তিন কাল-কে জানেন তাকে ত্রিকালজ্ঞ বলে।     এইখানে এসে সমস্যা শুরু হল। চেষ্টা করলে অতীত কালকে জানা গেলেও ভবিষ্যত কালকে কিভাবে জানা সম্ভব ? আমাদের প্রাচীন মুনি-ঋষিরা তাদের নানা শাস্ত্র আলোচনায় বলেছেন যে জানা  সম্ভব । আসলে সময়কে আমরা যেভাবে অনুভব করি সেভাবে সম্ভব নয়। যেমন পৃথিবীতে বসে সেটি সূর্যের চারদিকে ঘুরছে অনুভব করা সম্ভব নয় । এটি অনুধাবন করতে বিশেষ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রয়োজন । তেমনই সময়কে অনুধাবনে জন্য বিশেষ প্রজ্ঞাবান হতে হবে । আসলে সময় নাকি গতিশী...

সাংখ্য প্রবচন সুত্র ৩

    সাংখ্য আলোচনা চলতে চলতে মাঝপথে থেমে কৃষ্ণ - অর্জুন সংবাদ , এমনকি প্রেম-ভক্তির পদাবলী ও চলে এলো । এরকম কেন হয় ? একটি serious ধর্মী শুষ্ক তত্ত্ব আলোচনার মাঝে কি করে অন্য বিষয় আসতে পারে ?        আসলে এটাই হয়। এমনটাই হয়। আমাদের সকলেরই হয়। যা যা প্রবৃত্তি বা চিন্তন এতোদিন ধরে জড়িয়ে রয়েছে, তা শুধুমাত্র মুখে বললেই শেষ হয়ে যায় না। আমরা জানি আমাদের সকলের ভেতরেই এই প্রবৃত্তির তাপ-দাহ বর্তমান।  তাকে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে অস্বীকার করার চেষ্টা করতেই পারি, কিন্তু তার থেকে সহজ হল তাকে ভোগের মাধ্যমে নিবৃত করা। যা সব ছিল মনের গভীরে এই অবসরে তা নির্গত হল। ' তেন ত্যাক্তেন ভুঞ্জিথা ' ।   ত্যাগ করতে করতে ভোগ বা ভোগ করতে করতে ত্যাগ হল।       আমরা বলছিলাম, সাংখ্য দর্শন প্রাচীণ হলেও এর সকল রচনা প্রাচীণ নয়। এর আগে আমরা দেখেছিলাম, 'সাংখ্য কারিকা'-তে শ্রূতি বা অনান্য শাস্ত্রের উল্লেখ নেই। কিন্তু প্রবচণ সূত্রে এ কথা বলা থাকায়, এটির প্রাচীণত্ব নিয়ে সংশয় আছে।      আবার প্রথম অধ্যায়ের ২৮ তম সূত্রে ' পাটলিপুত্র' -এর নাম  থাকায় বোঝা যায় এটি...

অর্জুন - কৃষ্ণ সংবাদ 3

   অর্জুন আর কৃষ্ণ দুজনেই সমবয়সী । একই বছরে জন্ম। দুজনেই রাজবংশের সন্তান । অথচ জন্ম হল রাজধানী থেকে দূরে । একজন উত্তরাখণ্ডের বনবাসে এবং অন্যজন গোয়ালাদের মাঝে। ক্ষত্রিয় কর্ম-প্রারব্ধ তাদের দুই শ্রেষ্ঠ ন্যায়নিষ্ঠ বীর হিসাবে মনে রেখেছে হাজার হাজার বছর ধরে ।   বীর তো দুর্যোধনও ছিলেন, কর্ণও ছিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ আর ভীম, অশ্বথ্বামাও মহান বীর ছিলেন । তাহলে অর্জুন-কৃষ্ণ কোথায় special  ?   জীবনের অন্তে সর্গারোহণ পথে অর্জুন যখন মৃত হলেন, যুধিষ্ঠীর বলেছিলেন, অর্জুন পরিহাসছলেও কখনও মিথ্যা কথা বলেননি । কে বলছেন ? যাকে সবাই 'সত্যবাদী যুধিষ্ঠির' বলে এবং যিনি দ্রোণকে পরাস্ত করতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন ।   ভাইদের দেওয়া কথা  (দ্রৌপদী issue তে, মনে রাখতে হবে দ্রৌপদীকে তিনি সয়ম্বরে একা লড়ে অর্জন করেছিলেন ) এক ব্রাহ্মণের স্বার্থরক্ষায় ভঙ্গ করে 12 বছর একাকী চলে গেলেন। ফিরলেন পাশুপত অস্ত্র এবং স্বর্গে দেবতাদের হয়ে যুদ্ধ করে নিবাত-কবচ , কালকেয়দের পরাস্ত করে অনেক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে । সত্য রক্ষা করলেন এবং negative situation কে positively gain করে ফিরে এলেন ।   কৃষ্ণ ...

অর্জুন - কৃষ্ণ সংবাদ ২

      দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা শেষে ৫ ছদ্মবেশী ব্রাহ্মণকে অনুসরণ করে কৃষ্ণ তার পিসতুতো ভাই পান্ডবদের দেখা পেলেন। এর আগে বারনাবতের জতুগৃহ থেকে এদের খোঁজ করছিলেন। পান্ডবরা এ পর্যন্ত বিশেষ কিছু করে উঠতে না পারলেও কৃষ্ণ কংসকে বধ করে যদুবংশে আবার গণতন্ত্র ( নামমাত্র উগ্রসেন রাজা) স্থাপন করেছেন। বিনিময়ে জরাসন্ধ ২১ বার মথুরা আক্রমণ করায় ( প্রতিবার কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মোট সৈন্যের থেকে বেশী সৈন্য নিয়ে)। ফলতঃ দ্বারকাতে নতুন করে বসতি স্থাপন করতে হয়েছে। সবই কৃষ্ণের নেতৃত্বে।      ইন্দ্রপ্রস্থ স্থাপন করতে কৃষ্ণ যখন হস্তিনাপুরে তখন পার্শ্ববর্তী অসুর রাজা দ্বারকা তছনছ করে দিয়ে গেছে। ফিরে এসে সেই লড়াই নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে পাশাখেলার সময় থাকতে পারলেন না। দ্রৌপদীর গঞ্জনাও শুনতে হল এর দরুন। এছাড়াও নরকাসুর, মুচকুন্দ ইত্যাদি কতোজনের সাথে যে কৃষ্ণকে লড়াই করতে হল ( রুক্মিনী কে বিবাহ জনিত লড়াই, সমন্তক মণি নিয়ে লড়াই - এসব ছোটখাটো লড়াই বাদ-ই দিলাম) তার বিবরণ ভাগবতে বা হরিবংশে পাওয়া যায়।      কই, কোনও লড়াইতে তো পান্ডবদের কৃষ্ণের পাশে দেখা গেল না। বলা যেতে পারে পা...

অর্জুন - কৃষ্ণ সংবাদ 1

  কুরুক্ষেত্রে স্বজন পরিবৃত অর্জুন বললেন, " এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ...কিং নু মহীকৃতে । 1/34 - যদি এরা আমায় মেরেও ফেলে তবুও স্বর্গ রাজ্য পেলেও এদের হত্যা করতে চাই না ।    এসব বলে তিনি ধনুর্বাণ ত্যাগ করে বিষন্ন মনে রথের উপর বসে পড়লেন(1/46) ।     এরপর কৃষ্ণ সাংখ্য থেকে শুরু করে 17 অধ্যায় ধরে নানান উপদেশ দিয়ে শেষ করলেন এই বলে যে,  "যদহঙ্কারমাশ্রিত্য.....প্রকৃতিস্ত্বাং নিযোক্ষ্যতি । 18/59  - তুমি অহঙ্কার কে আশ্রয় করে 'যুদ্ধ করব না' মনে করছ, এ ভাবনা মিথ্যা। তোমার প্রকৃতিই তোমাকে যুদ্ধে নিযুক্ত করবে ।  এবং   "স্বভাবজেন কৌন্তেয় ...করিষ্যবশোপি তৎ । 18/60 - মোহবশত যা করতে চাইছ না, তোমার স্বভাবজাত কর্ম প্রবৃত্তি দ্বারা সেটাই তুমি করবে ।     এটাই যুদ্ধের আগে কৃষ্ণের শেষ কথা । কারণ এর পরে আর কথা কিছু নেই । কৃষ্ণ বলছেন, সব ছেড়ে তাকে শরণ নিতে । অর্থাৎ তিনি যা বলছেন তা-ই শুনতে । তিনি রক্ষা করবেন ।   যদি প্রবৃত্তি দ্বারা আমরা পরিচালিত হই তাহলে 18 অধ্যায়ের ধরে এতো তত্ত্ব কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল । অর্থাৎ বোঝা গেল হাজার উপদেশেও কিছু হয় না...

সাংখ্য প্রবচন সূত্র 2

 " প্রাত্যহিক ক্ষুৎপ্রতিকার....। 3 " সর্ব্বাসম্ভবাৎ সম্ভবে..... । 4 " উৎকর্ষাদপি মোক্ষস্য .... । 5   যেমন ভোজনে ক্ষুধা নিবৃত হয়, তেমনই ধনাদির দ্বারা স্থুল দুঃখ নিবৃত হয়। কিন্তু সে নিবৃত্তি পরম নয়। কারণ নানা ভাবে পুনরায় নানারকম দুঃখের সৃষ্টি হয়।   তাই প্রমাণজ্ঞ, কুশলী ও বিবেকী মানুষ  লৌকিক উপায় ত্যাগ করে শাস্ত্রীয় উপায় অবলম্বন করেন ।   ভগবৎ গীতার 18 অধ্যায়ের 2-11 শ্লোকে ত্যাগের মাধ্যমে মোক্ষের বর্ণনা আছে ।   কাম্যকর্মের ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে। মোহ বশতঃ নিত্য কর্মত্যাগকে তামস ত্যাগ, কর্তব্য কর্ম কষ্টকর মনে করে ত্যাগকে রাজস ত্যাগ এবং কর্তৃত্বাভিমান ও ফলাকাঙ্খা ত্যাগ করে কর্তব্য কর্ম করাকে সাত্বিক ত্যাগ বলে।  "যস্তু কর্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে"  -  যিনি  কর্ম করেও কর্মফল ত্যাগ করেছেন তিনিই প্রকৃত ত্যাগী বলে অভিহিত হন।    সাংখ্য 5 নং সূত্রে বলা হচ্ছে, মোক্ষ লাভ যে রাজ্যধনাদি লাভের থেকে উৎকৃষ্ট তা শ্রুতিতে বলা আছে ।    এখানে বলা যেতে পারে এই যে শ্রুতি-র কথা বলা হল, এতে বোঝা গেল 'সাংখ্য প্রবচন সূত্র ' প্রাচীন রচ...

সাংখ্য প্রবচন সূত্র 1

      সাংখ্য ভারতের অন্যতম প্রাচীন, মতান্তরে প্রাচীনতম দর্শন । তবে পন্ডিতরা বলেন আদি কপিল তার মা দেবাহুতি (ভাগবতে বর্ণিত )-কে যে দর্শন বুঝিয়েছিলেন তা পাওয়া যায় না। ঈশ্বর কৃষ্ণ কৃত 'সাংখ্য কারিকা '-কে প্রাচীনতম ধরা হয়। শঙ্করাচার্য একাধিক কপিল মুনি র অস্তিত্ব মেনে নিয়েছিলেন । যেমন পরম্পরাগতভাবে শঙ্করাচার্য আজও আছেন। এমনই কোনও এক বা একাধিক কপিল কর্তৃক রচিত হল 'সাংখ্য প্রবচন সূত্র '।   'কারিকা'-র পরিপূরক বা ব্যাখ্যা হিসাবে এটি গ্রহণ করা যেতে পারে । তবে কোথাও বিরোধ হলে 'কারিকা'-কেই প্রামাণ্য ধরতে হবে । "অথ ত্রিবিধদুঃখাত্যন্তনিবৃত্তিরত্যন্তপুরুষার্থঃ । সূত্র  1 - 'অথ' শব্দের উচ্চারণ মঙ্গলজনক। বলা যায় এই শাস্ত্রের শুভ আরম্ভ হল।   ত্রিবিধ দুঃখ ( আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক ) -এর অন্ত হলে পরম পুরুষার্থ লাভ হবে । এখানে 'অত্যন্ত পুরুষার্থ ' -কে কেউ কেউ 'পরম পুরুষার্থ ' ধরেছেন । এই পরম পুরুষার্থ লাভ করাতেই মুক্তি বা মোক্ষ লাভ ধরা হয়েছে । এই পরম পুরুষকে কে কি আমরা পরমাত্মা জ্ঞান করতে পারি  ? উপনিষদে সমসাময়িক সময়ে কিন্তু এই ভাবন...

সাংখ্য দর্শন 14

  যে উদ্দেশ্য নিয়ে diary লেখার মতো করে সাংখ্য ও অন্যান্য দর্শন নিয়ে social media তে আলোচনা শুরু করা হয়েছিল তা অনেকটাই সফল বলা যেতে পারে । শ্রমদপ্তরে পরিশ্রম ও পণ্ডশ্রম করার পরে যতটুকু আত্মজিজ্ঞাসা-র অবকাশ থাকে তা একাকী শাস্ত্র পাঠে তৃপ্ত না হওয়ার ফলে গুনী, জ্ঞানী ও আগ্রহী মানুষদের অংশগ্রহণে নিজেকে আরও উন্নত করা যায় কিনা এটি পরিক্ষনীয় ছিল । মূলতঃ ভাতৃপ্রতীম সমাজরক্ষক তাপসের সৌজন্যে সুখেনবাবু, দর্শনের অধ্যাপক সুকান্তবাবু এবং প্রণববাবুর মতন অনেকেই আমার কৃতজ্ঞতা ভাজন হয়েছেন। কেউ পথ দেখাচ্ছেন, কেউ বা ভুল সংশোধন করে দিচ্ছেন, কেউ বা উৎসাহ দিচ্ছেন, আবার শ্রাবণী বা কাবেরী দেবীর  মতো কারো কারো আগ্রহী প্রশ্নে ভাবনার নব দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে ।  আরো অনেকেই পরোক্ষে উৎসাহ দিচ্ছেন নানাভাবে । এই  অবকাশে আমার এই soul searching যাত্রাপথে সকল সহযাত্রীকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই ।    সাংখ্য দর্শন ঈশ্বর নিয়ে কিছু বলে না,  পরমাত্মা বা পরম পুরুষ নিয়েও কিছু বলে না । শুধু পুরুষ ও প্রকৃতি । এই দুই এর পারস্পরিক সম্পর্ক । একদিকে ভোগ ও অন্যদিকে মুক্তি । মাঝে দুএর সংযোগে ভোগ এবং ক...