অর্জুন - কৃষ্ণ সংবাদ 3

   অর্জুন আর কৃষ্ণ দুজনেই সমবয়সী । একই বছরে জন্ম। দুজনেই রাজবংশের সন্তান । অথচ জন্ম হল রাজধানী থেকে দূরে । একজন উত্তরাখণ্ডের বনবাসে এবং অন্যজন গোয়ালাদের মাঝে। ক্ষত্রিয় কর্ম-প্রারব্ধ তাদের দুই শ্রেষ্ঠ ন্যায়নিষ্ঠ বীর হিসাবে মনে রেখেছে হাজার হাজার বছর ধরে ।
  বীর তো দুর্যোধনও ছিলেন, কর্ণও ছিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ আর ভীম, অশ্বথ্বামাও মহান বীর ছিলেন । তাহলে অর্জুন-কৃষ্ণ কোথায় special  ?
  জীবনের অন্তে সর্গারোহণ পথে অর্জুন যখন মৃত হলেন, যুধিষ্ঠীর বলেছিলেন, অর্জুন পরিহাসছলেও কখনও মিথ্যা কথা বলেননি । কে বলছেন ? যাকে সবাই 'সত্যবাদী যুধিষ্ঠির' বলে এবং যিনি দ্রোণকে পরাস্ত করতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন ।
  ভাইদের দেওয়া কথা  (দ্রৌপদী issue তে, মনে রাখতে হবে দ্রৌপদীকে তিনি সয়ম্বরে একা লড়ে অর্জন করেছিলেন ) এক ব্রাহ্মণের স্বার্থরক্ষায় ভঙ্গ করে 12 বছর একাকী চলে গেলেন। ফিরলেন পাশুপত অস্ত্র এবং স্বর্গে দেবতাদের হয়ে যুদ্ধ করে নিবাত-কবচ , কালকেয়দের পরাস্ত করে অনেক অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে । সত্য রক্ষা করলেন এবং negative situation কে positively gain করে ফিরে এলেন ।
  কৃষ্ণ দ্রৌপদীর বিশেষ বন্ধু । তার বিপদে সর্বদাই কৃষ্ণ আছেন। ভাবা হয় এ দুজনের প্রণয় ছিল । আমরা ভুলে যাই দ্রৌপদীর রূপে মুগ্ধ সমগ্র ভারতীয় বীর  ( এমনকি জরাসন্ধও) সয়ম্বরে  অংশ নিলেও কৃষ্ণ সয়ম্বর সভায় উপস্থিত থাকলেও অংশ নেন নি। কৃষ্ণ প্রতিযোগিতায়  অংশ নিলে তাকে হারাতো কে ? সব বন্ধুত্বকেই একটি angle এ দেখা কি খুবই প্রয়োজন ?
   আসলে মহানরা যে ব্যক্তি স্বার্থ, লোভ এবং কামনা বাসনার বাইরে বিশেষ নীতি -আদর্শ নিয়ে কাজ করেন, আমরা সাধারণ মানুষ তা বুঝতে ভুল করি ।
   কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে  পান্ডবদের নীতিহীনতার কথা বলা হয়। অভিমন্যুকে সপ্তরথি  ঘিরে হত্যা করে শর্তভঙ্গ করেন কৌরবরাই প্রথমে। শিখণ্ডীকে সামনে রেখে লড়ার বুদ্ধি ভীষ্ম নিজেই দিয়েছিলেন এটা ভুলে গেলে চলবে না ।
  ভীষ্ম হস্তিনাপুরের সিংহাসন রক্ষার প্রতিজ্ঞাতে বদ্ধ ছিলেন । সত্য পান্ডবদের পক্ষে ছিল তা তিনি জানতেন । অশ্বথ্বামাও রাতে নিদ্রিত লোকেদের হত্যা করে সব সম্মান নষ্ট করেছেন । আর ব্রাহ্মণ দ্রোণ শিষ্যদের দিয়ে দ্রুপদ রাজ্যের অর্ধেক ছিনিয়ে নিয়ে  ( শুধু Ego দেখাতে, এটা ব্রাহ্মণের কাজ নয়) আগেই পতিত হয়েছিলেন । তাকে হত্যা করে দ্রুপদ পুত্র ধৃষ্টদুম্ন, পান্ডবরা নয়।
  ভীম নিয়ম ভঙ্গ করে গদাযুদ্ধে দুর্যোধনকে হারালেন । যদিও বলা যেতে পারে 'nothing is unfair in love and war', তবুও অর্জুন তো অন্যায় যুদ্ধ করেন নি । পরস্পরকে তীর ছুঁড়ছে, এ অবস্থায় কর্ণের রথের চাকা ডুবে গেলে অর্জুন কি করবে ? এই কর্ণই তো বালক অভিমন্যুকে অসহায় অবস্থায় সবাই মিলে হত্যা করেছিল । দ্রোণও সে দলে ছিল।
  বলা হয় সমস্ত কূট বুদ্ধির জনক হল কৃষ্ণ । কূট বুদ্ধি কি খারাপ  ? কৌটিল্যের 'অষ্টাদ্ধায়ী' কি বলে ? আজও কূটনৈতিক কাজকে বিশেষ সম্মান দেয়া হয়ে থাকে । আর কৃষ্ণ এ কাজ করছেন কি নিজের স্বার্থে ?
   সত্য রক্ষা  ( commitment) বড় / মহান মানুষদের বিশেষ ধর্ম । যে কারণেই হোক কৃষ্ণের যুদ্ধে অংশ না নেওয়া নিয়ে অর্জুনের ক্ষোভ নেই । তার friend, philosopher and guide তার সাথে আছে, এতেই তার তৃপ্তি । এমনকি উত্তেজিত কৃষ্ণ যখন তেড়ে যাচ্ছেন ভীষ্মের দিকে অর্জুনই তাকে করজোড়ে থামাচ্ছেন । সত্য থেকে কৃষ্ণকে বিচ্যুত হতে দিলেন না । অথচ কৃষ্ণ যুদ্ধে নামলে তার সমূহ সুবিধা ।
   বহুবিবাহ  ( তৎকালের সমাজ জীবনের অঙ্গ) কে যদি বাদ দিই আমরা দেখব অর্জুন ও কৃষ্ণ আসলে ত্যাগী কর্মযোগী। নিজের সুখভোগের জন্য প্রায় কিছুই করেননি । যুধিষ্ঠির ও বলরাম, মাথার ওপর দুজনেরই দুই এলোমেলো দাদা । কে পাশা খেলতে বলল?  কেই বা সর্বস্ব বাজি রাখতে বলল ? আমাকে উসকালেই আমি সর্বনাশের পথে যাব ? এই আমি ধর্মরাজ ? ভীম তো বলেছিল,  যে হাতে পাশা খেলেছিল সেই হাত পুড়িয়ে দেবে । অজ্ঞাতবাসে গিয়ে বিরাট রাজার সাথে সেই পাশা খেলতেন । এতো সর্বনাশের পরেও । বলরাম দিনরাত মাধ্বী সেবন করে কাটাতেন । মাঝেমধ্যেই উত্তেজিত হয়ে একে তাকে আক্রমণ করতে যেতেন । কৃষ্ণ আবার বুঝিয়ে ফেরৎ আনতেন।
   কৃষ্ণ মথুরার রাজা হতে পারতেন, হননি । জরাসন্ধ, শিশুপাল, নরক সবাইকে হত্যার পরে তাদের পুত্রদের রাজা করেছেন । সে আমলে এটা ভাবাই যেত না যে বিজয়ী রাজ্য দখল করবে না ।
   অর্জুন মণিপুর রাজ্য এবং চিত্রাঙ্গদা ও উলুপীর প্রেম ছেড়ে ফিরে এলেন সত্য ও কর্তব্য রক্ষার্থে । সেই অলস দাদাকে রাজা করলেন । অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটালেন দাদার জন্য । নিজে কি ভোগ করলেন ? জন্মের পর 11 বছর জঙ্গলে, জতুগৃহ থেকে পালিয়ে 3/4 বছর বনে,  12 বছর একাকী ভ্রমণ, 13 বছর বনবাস ও অজ্ঞাতবাস। এরপর রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য কয়েক বছর বাইরে । একটা মানুষ যদি 45 বছর বনে-জঙ্গলে আর রণক্ষেত্র কাটায় তাহলে সে জীবনে সুখভোগ করল কখন ?
  জরাসন্ধের সাথে  19 বার,  শিশুকাল থেকে তাড়কা -ইন্দ্র ইত্যাদির সাথে লড়াই । পরে পৌন্ড্র বাসুদেব, নরকাসুর ও আরও অজস্র লড়াই । এরপরেও পান্ডবদের জন্য মাঝেমধ্যেই ছোটা । কৃষ্ণই বা সুখভোগ করল কখন ? আরাম-আয়েশ কার না ভালো লাগে । এসবের উর্ধ্বে উঠেছিলেন বলেই তো এনারা নায়ক । সকলের পূজ্য যুগে যুগে ।
    এই দুই মহান মানুষ আজন্ম বন্ধুত্ব বজায় রাখলেন । আমরা অবাক হয়ে তাদের নিস্বার্থ কর্মযোগের সাক্ষী রইলাম যুগে যুগে । কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর ভারতে প্রকৃতই ধর্মরাজ্য স্থাপিত হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে । তবে এই দুই মহানায়ক যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়ে গেছেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই ।

Comments

Popular posts from this blog

কঠোপনিষদ ২০

উপনিষদ পর্ব 1

মহাভারত শ্লোক