উপনিষদ ( মান্ডুক্যোপনিষদ 3) 9

     বেলুনের মধ্যকার বাতাস যেরূপ বাইরে ব্যপ্ত বাতাসেরই অংশ, জীবাত্মা তেমনই সমগ্র পরমাত্মার অংশ মাত্র । বেলুন ছিদ্র হলে যেমন বাতাস নির্গত হয়ে সমগ্র বাতাসে মিলিত হয়, আত্মাও সেই প্রকার জীবের মৃত্যুর পর পরমাত্মার সাথে যুক্ত হয় । বাতাসে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি গ্যাস যে প্রকারে পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখে  ( সাধারণ অবস্থায় আমরা যদিও তা অনুধাবন করতে পারি না ), আমাদের আত্মাও মৃত্যুর পর পরমাত্মায় যুক্ত হলেও বিলীন হয়ে যায় না ।  কেবল পার্থিব বন্ধন মুক্ত আত্মাই পরম ব্রহ্ম বা পরমাত্মায় বিলীন হন । সেই অবস্থায় তিনি জন্ম -মৃত্যুর অতীত হন । যেমন বেলুন থেকে নির্গত বাতাস থেকে পুনরায় অন্য বেলুন ফোলানো সম্ভব, তেমনই মৃত্যুর পর পুনর্জন্ম সম্ভব । এই বেলুন উপমা দিয়ে সমগ্র তত্ত্ব অনুধাবন সম্ভব নয়, যদিও কিঞ্চিত আভাষ প্রদান করা গেল ।
     জীবাত্মা বিভিন্ন বিবর্তনের প্রক্রিয়া অতিক্রম ( এটাই rule of nature, চাইলেও হবে, না চাইলেও হবে ) করে  ক্রমে মানুষ স্তরে উপনীত হয় ( পৃথিবীর ক্ষেত্রে আলোচিত ।  সৌরজগতের অন্যত্র এবং বাইরে অন্য জীবন চক্র চলে )। মানুষ জন্মেও বিবর্তন চলতে থাকে একাধিক জন্ম ধরে । আত্মা ক্রমশ স্থুল থেকে সূক্ষ্ম অবস্থায় উত্তীর্ণ হতে থাকে । মানুষই একমাত্র জীব  ( পার্থিব জীব বিচারে) যে বিবর্তনের এই গতিকে ত্বরান্বিত  ( accelerate ) বা মন্দীভূত করতে পারে ।
    উপনিষদের ঋষি জানিয়েছেন জীবাত্মার চতুষ্পাদের কথা । উপমা স্বরূপ তিনি জাগ্রত,  স্বপ্ন, সুষুপ্তি এবং তুরীয় অবস্থার কথা বলেছেন । বিবর্তনের এই চার স্তরে আত্মা ক্রমে চারটি অবস্থায় উপস্থিত হয় । স্থুল,  সূক্ষ্ম, সূক্ষ্মতর এবং সূক্ষ্মতম ।
   1। প্রথম পাদ হল জাগ্রত অবস্থা। এটি মানুষের আত্মার স্থুল অবস্থা। এসময় ভোগ দেহকেন্দ্রিক হয় । ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ভোগ চলতে থাকে । গান শোনা, রসনা তৃপ্তিতে আহার, বেড়াতে যাওয়া, প্রকৃতি দর্শন ইত্যাদি  এ অবস্থার উদাহরণ । মনুষ্যেতর জীব এই কাজগুলি করে না । তাদের সমগ্র কর্ম জীবন ধারনের জন্য । জঙ্গলের হরিণ নদীর ধারে গিয়ে জল বা ঘাস খাবে, নদীর সৌন্দর্য নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই । জল পরিষ্কার এবং নিকটে প্রাণঘাতী বাঘ, সিংহ জাতীয় কেউ না থাকলেই সে তৃপ্ত।  মানুষ জীবন ধারনের জন্য কর্মের পাশাপাশি এ ধরনের উপভোগ বা entertainment মূলক কাজ করবে । নিতান্ত গরীব মানুষও গান গাইবে বা মেলায় যাবে । ইন্দ্রিয়গত উপভোগের এই অবস্থায় আত্মা  ( যে মূলতঃ নির্বিকার এসব ভোগ বাসনায়) জ্ঞান সঞ্চয় করে চলবে ।
   বুদ্ধ - শঙ্করাচার্যের মতন সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষদের প্রভাবে পরবর্তীকালে এক বিসম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে । দোষ তাদের নয়, আমাদের । স্কুল পাঠ্য বিজ্ঞান যথার্থ অনুধাবন না করে আমরা higher science পড়তে বসেছি । জাগ্রত আত্মার ভোগ-প্রবৃত্তির স্তর অতিক্রম না করে আমরা তাদের follow করতে গিয়ে দরকচা অবস্থায় এসেছি । প্রবৃত্তির স্তরের পূর্ণতা হলে সেটি আর তৃপ্তি দেয় না । তখন শুরু হয় অন্তরের অন্বেষণ। শুরু হয় দ্বিতীয় পাদ । ঋষি যাকে স্বপ্ন দশা বলছেন । বুদ্ধ - শঙ্করাচার্য ও একথা জানতেন । তারা উন্নত অবস্থার কথা বলেছেন । সেই অবস্থায় পূর্বের ভোগাদি বিস্বাদবৎ বোধ হয় । কিন্তু আত্মার অতৃপ্ত অবস্থায় বলপূর্বক নিবৃত্তির চেষ্টায় যে বিষময় ফল হয় তার প্রমাণ স্বরূপ আমরা দেখেছি প্রায় সকল ধর্মের মঠ-মিশনে ভোগ-বিলাসিতা-ব্যাভিচারের ছড়াছড়ি । কেউ জোর করে সাত্বিক জীবন যাপন করলেও মুক্তি নেই । পরজন্মে পুনরায় তার প্রকাশ ঘটে । Past life regression এর প্রবক্তা বিখ্যাত psychologist Dr Brian J Weish এর case study অনুসরণ করলে এই তত্ত্ব সম্যক উপলব্ধ হয় ।
   শঙ্করাচার্য বা বিবেকানন্দের মত আজন্ম ব্রহ্মচারীকে শুধু এই জন্মের অবস্থা দিয়ে বিচার করলে আমরা আংশিক সত্যকে দেখতে পাই । ভোগ -প্রবৃত্তির দশা পেরিয়ে যে এই স্তরে আসা হয় তা বুদ্ধের জাতক কাহিনী গুলো দ্বারা বোঝা যায় ।
    জীব মানুষ জন্মের আগে ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগ করে কেবল জীবনধারণের জন্য । মানুষ জন্মে সে জীবনধারণ ছাড়াও উপভোগ অর্থে এর প্রয়োগ করে । মানব জনমেরই কোনও স্তরে তার এতে ক্লান্তি আসে, শুরু হয় অন্তর্যাত্রা,( এ অবস্থায় তার কিছুই ভালো লাগে না ) আত্মা তার মূল পরমাত্মার সন্ধান শুরু করে, জেনে বা না জেনে । শুরু হয় আত্মার দ্বিতীয় পাদ ।
     অল্পজ্ঞানে আমরা ভোগ-বিলাসের বিপরীতে সত্ত্ব গুণের চর্চাকে সত্য আর বাকি সবকে মিথ্যা ভাবতে পারি,  কিন্তু উপনিষদের ঋষি প্রথম দশাকে ঘৃণা করার কথা বলেননি । বলেছেন এ অবস্থায় আত্মা জ্ঞান অর্জন ও সঞ্চয় করে । সেই জ্ঞান তাকে দ্বিতীয় স্তরে উত্তীর্ণ করে । ঋষি বলেছেন,
   'জাগরিতস্থানো বহিষ্প্রজ্ঞ'
   - এ অবস্থায় সে বাইরের জ্ঞান লাভ করে প্রজ্ঞাবান হয় । এই প্রজ্ঞা তাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যায় । যেমন School পাশ করে College এ যাওয়া । আমার দাদা  College এ পড়ে, বাড়িতে তার বই পড়ে আমি কিছু theory মুখস্থ করতে পারি। কিন্তু প্রকৃত উপলব্ধির জন্য আমাকে School এর পাঠ সমাপ্ত করে আসতে হবে ।
এই হল প্রবৃত্তি থেকে নিবৃত্তির মার্গ । অসুর গুরু শুক্রাচার্য প্রদর্শিত পথ ।
--  ক্রমশঃ

Comments

Popular posts from this blog

কঠোপনিষদ ২০

উপনিষদ পর্ব 1

মহাভারত শ্লোক