Sandip manna
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য জাতি তত্ত্ব (পর্ব - ৩)
================================
২য় পর্বের লিংক -
https://www.facebook.com/groups/sukumarray/permalink/2352187834796562/
রিসলে ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞের মতামত
----------------------------------------------------
ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকার্যের শুরুতেই ব্রিটিশরা বুঝেছিল, যেহেতু শাসক সম্প্রদায় মূলত মুসলমান, তাই ভারতের উচ্চবর্গের (উচ্চবর্ণীয়) হিন্দুদের নিজেদের দলে টানতে হবে, নাহলে শাসন-শোষণ চালানো মুশকিল। তাই এমন এক পুরাকথা মিশ্রিত ইতিহাস (Mythical history) তৈরি করতে হবে যেখানে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরাই সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে থাকবে। তাই, সেই ইতিহাস ‘took shape when brown sahibs and white sahibs sought to escape their fears about the instability of social hierarchy by giving it a biological basis and projecting it into the past - thus covering extant hierarchies with the mantle of the natural and the primordial’. (Guha S., ‘Lower Starta, Older Races And Aboriginal Peoples: Racial Anthropology And Mythical History Past And Present’, The Journal of Asian Studies, 57(2), 1998, pp. 423-41.)
১৯০১ সালে ব্রিটিশ ভারতের কমিশনার অফ সেনসাস পদে নিযুক্ত হলেন H.H. Risley মহাশয়। তিনি তাঁর অফিসারদের দিয়ে সারা ভারতের নৃতাত্ত্বিক তথ্য যোগাড় করে(!) ১৯০৮ সালে একটি রিপোর্ট খাড়া করলেন। সেই রিপোর্টে জানালেন, তিনি ভারতের মানুষদের মধ্যে সাত রকমের জাতিভাগ (Racial Category) পেয়েছেন: তুর্ক-ইরানিয়ান, ইন্দো-এরিয়ান, সিথো-দ্রাবিড়িয়ান, আর্য-দ্রাবিড়িয়ান, মঙ্গোল-দ্রাবিড়িয়ান, মঙ্গোলয়েড এবং দ্রাবিড়িয়ান। রিসলের রিপোর্ট জানাল, উত্তরভারতের ব্রাহ্মণ ও উচ্চ বর্ণের মানুষদের মধ্যেই দীর্ঘ মস্তক-বিশিষ্ট (Dolichocephalic or Long-headed) বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে এবং এঁরাই হলেন বহুদিন পূর্বে আগত শ্রেষ্ঠ আর্য জাতির বংশধর। রিসলের মস্তিস্কে নিশ্চয়ই দুটি বিষয় কাজ করেছিল, ১) নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ সংক্রান্ত সামাজিক কড়া প্রথা এবং ২) পেশাগত বৈশিষ্ট্য (একজন ব্রাহ্মণ কি অন্যের ব্যবহৃত, ছেঁড়া পাদুকা সেলাই-এর কাজ করত নাকি মাথায় করে অন্যের গুয়ের হাঁড়ি বয়ে নিয়ে যেত?)।
রিসলের তত্ত্ব নিয়ে আপত্তি উঠল এই কারণে যে, উত্তরভারতের সকল ব্রাহ্মণরাই দীর্ঘ মস্তক-বিশিষ্ট নয় এবং সুদূর মঙ্গোলিয়ান ও ভারতীয় আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্যও তাদের মধ্যে বিদ্যমান। পশ্চিম ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র এবং পুব ভারতের বাংলা, উড়িষ্যায় প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পাওয়া যাচ্ছে ভুরি ভুরি। আবার উল্টোদিকে দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলা মানুষদের মধ্যে দীর্ঘ মস্তক-বিশিষ্ট মানুষও পাওয়া যাচ্ছে। রিসলে এই ধাঁধার উত্তরে সপাটে জানালেন, এটি যৌন সংকরায়নের ফলে ঘটেছে।
রিসলের তত্ত্বের বিরোধিতা করে R.P. Chanda ১৯১৬ সালে তাঁর ‘The Indo-Aryan Races’ বইতে পরিস্কারভাবে জানালেন, ব্রাহ্মণরাই শ্রেষ্ঠ জাতি (বর্ণ), সে তারা দীর্ঘ অথবা প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট যাই হোক না কেন। তিনি জানালেন আদৌ কোনরকম যৌন সঙ্করায়ন হয়নি। প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট আর্যদের উৎপত্তিস্থল সিন্ধু নদের ওপারের বালুচিস্তান এবং আফগানিস্তান। এখানকার Aryan/Iranian ভাষায় কথা বলা মানুষরাই সিন্ধু পেরিয়ে এদিকে এসেছিল এবং এদের থেকেই প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট ব্রাহ্মণদের ধারা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট বাঙালী ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চ বর্ণের বাঙালীদের উৎপত্তির মূল আদৌ মঙ্গোলয়েড জাতি নয় বরং তাকলামাকান মরুভূমি থেকে আগত বিশিষ্ট ও উচ্চ মানের আর্য জাতি।
১৯৩১ সালের সেনসাস রিপোর্টে কিছু পরিবর্তন এল। তার ভিত্তিতে নৃতত্ববিদ B.S. Guha জানালেন, ভারতের ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষদের মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় দীর্ঘ মস্তক-বিশিষ্ট ও আল্পীয় প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট মানুষদের বৈশিষ্ট্যের মিলন ঘটেছে। গুহ আরও জানালেন, বৈদিক আর্য জাতির আরো কিছু বিশিষ্টতা আছে। যেমন, শারীরিক দৈর্ঘতা, খাড়া বা টিকালো নাসিকা, দীর্ঘায়ত মুখাবয়ব, গৌরবর্ণ ইত্যাদি।
আর্য জাতির এই ধাঁচ নিয়ে এবং এভাবে জাতি নির্ধারণ করা নিয়ে বিশিষ্ট Racial Paleontologists A.C. Huddon, J.H. Hutton, G.M. Mortant, F.V. Luschan, E. Fischer, E.V. Eickstedt, A.K. Mitra, D.N. Majumdar, P.C. Dutta প্রমুখ তুমুল আপত্তি জানালেন।
সেইসব আপত্তিকে পাশে সরিয়ে রেখে ব্রিটিশ প্রভূরা আর্য জাতি সম্ভূত হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষদের দলে টানা শুরু করল। ব্রিটিশ প্রভূ ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির 'আয় ভাই কানাই-আয় ভাই বলাই, তোকে বুকে জড়িয়ে বগল বাজাই' প্রভাব লক্ষ্য করা গেল যখন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ না দিয়ে, স্বতন্ত্র হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার চেষ্টা শুরু করল।
১৯৯১ সালের বায়োলজিকাল অ্যানথ্রপোলজির গবেষণাপত্র
-----------------------------------------------------------------
১৯৯১ সালে Hemphill, Lukacs এবং Kennedy-র প্রকাশিত গবেষণাপত্র (*) জানাল যে, তথাকথিত আর্য অধ্যুষিত গান্ধার এবং তথাকথিত অনার্য অধ্যুষিত হরপ্পা অধিবাসীদের করোটির মাপজোক (Craniometric), দাঁতের গড়ন ও মাপ (Odontometric) এবং অসম্বদ্ধ প্রলক্ষণ (Discrete Trait) এর বৈশিষ্ট্য বিচার করে তাঁরা দেখেছেন, এই দুই জায়গার অধিবাসীদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য আছে।
প্রাগৈতিহাসিক ও বর্তমান পাকিস্তান এবং প্রাগৈতিহাসিক মিশর, আনাতোলিয়া, মেসোপটেমিয়া ও ইরানের মালভূমি অঞ্চলের করোটি ও কংকালের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের নমুনার তুলনামূলক বিচারও এই গবেষণায় করা হয়েছে। তাঁরা লক্ষ্য করেছেন সমগ্র সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক এবং বর্তমানকালের নমুনাগুলির (শুধুমাত্র মহেঞ্জোদারো অঞ্চল ব্যতিক্রমী) মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। হরপ্পার দুটি বিখ্যাত সমাধিস্থল, Cemetery R-37 এবং Cemetery H-এর কংকালের নমুনার মধ্যেও যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। আবার একই সাদৃশ্য তথাকথিত আর্য অধিকৃত গান্ধারের তিমরগড়ার সমাধিক্ষেত্রেও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, উপমহাদেশের প্রাগৈতিহাসিক নমুনাগুলির সঙ্গে মিশর, আনাতোলিয়া, মেসোপটেমিয়া ও ইরানের প্রাগৈতিহাসিক নমুনাগুলির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এরপর তাঁরা যে তথ্য পেশ করলেন, তা বিস্ফোরন ঘটালো ভারতের ইতিহাসে। তাঁরা বললেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে দুটিমাত্র জনতাত্ত্বিক বৈসাদৃশ্য (Demographic discontinuities) পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমটি হল, ৬০০০ থেকে ৪৫০০ খ্রিঃপূঃ-র মধ্যে (অর্থাৎ মেহেরগড়ের নব্যপ্রস্তর ও তাম্রপ্রস্তর যুগের সমকালীন) দ্বিতীয়টি ৮০০ খ্রিঃপূঃ-র পরে (ভারতীয় ইতিহাস অনুযায়ী যে সময়কে 'পরবর্তী বৈদিক যুগ' বলা হয়)।
পরিস্কারভাবে বললে বলতে হয়, হরপ্পার (সিন্ধু) নাগরিক সভ্যতার পতন (১৯০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ) -এর পরে ১৫০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ ভারতের বাইরে থেকে হিন্দুকুশ টপকে, ঘোড়ায় চেপে হা-রে-রে করতে করতে লৌহ অস্ত্রাদি সজ্জিত, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যদু, তুর্বশ, অনু, দ্রুহ, পুরু, ভরত প্রভৃতি গোষ্ঠীর আর্য ঋষি-মুনিদের চ্যালা-চামুন্ডা নিয়ে কিছু সময়ের ব্যবধানে দলে দলে ভারত আক্রমণ/আগমনের তত্ত্ব (Aryan Invasion/Migration Theory) এবং ভারতে এসে আর্য মশালের আলো জ্বালিয়ে ভারতের অসভ্য, বর্বর অন্-আর্যদের সভ্যতার আলো দেখানোর তত্ত্ব স্রেফ হাওয়ায় উড়ে গেল। একইসঙ্গে ধ্বসে পড়ল তথাকথিত আর্য জাতির মহিমা ও গরিমা। বাইরে থেকে যদি কেউ এসেও থাকে, হয় ৪৫০০ খ্রিঃপূঃ-র আগে এসেছে নয়তো ৮০০ খ্রিঃপূঃ পরে এসেছে।
তা’হলে? ঔপনিবেশিক ভাষাতত্ত্ব ঘেঁটে ঘ!!!
(*) গবেষণাটি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল অবধি নিম্নলিখিত তিনজন সম্পন্ন করেছিলেন -
1. Brian E. Hemphill, Associate Professor, Dept. of Anthroplogy, University of Alaska Fairbanks, Alaska, USA.
2. John R. Lukacs, Professor, Dept. of Anthropolgy, University of Oregon, Eugene, Oregon, USA.
3. Kenneth Adrian Raine Kennedy, Ex. Professor Emeritus of Ecology and Evolutionary Biology, Anthropology and Asian Studies in the Division of Biological Sciences at Cornell University, New York, USA.
একদল ঐতিহাসিকের হইচই
---------------------------------------
এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হওয়ার পরে ভারতের একদল ঐতিহাসিক হইচই করে উঠলেন। তাঁরা বললেন, আমরা তো আগেই বলেছিলাম –
১) বৈদিক-আর্য সভ্যতা বহু বহু প্রাচীন, সম্পূর্ণ এক ভারতীয় সভ্যতা,
২) ঋগ্বেদ অন্তত ৫০০০ খ্রিঃপূঃতে রচিত,
৩) সেই কারনেই বৈদিক সাহিত্যে গ্রামীণ সংস্কৃতির কথা বলা আছে,
৪) বেদ রচনার পরবর্তীকালে এই আর্যদের হাতেই ধীরে ধীরে হরপ্পার নাগরিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল,
৫) এই ভারতীয় আর্যরাই ভারতে সভ্যতার আলো জ্বালিয়েছিল,
৬) এই ভারতীয় আর্যরাই ক্রমশ পুব থেকে পশ্চিমে গিয়ে ইরানে জেন্দ-আবেস্তা লিখেছিল, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে মিত্তানি সভ্যতার পত্তন করে দিনে পাঁচবার সূর্য নমস্কার প্রথা শুরু করেছিল (যার ফলশ্রুতিতে, পরবর্তীকালে ইসলামে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রথা) ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য জাতির অস্তিত্ত্ব
----------------------------------------------------------
Case Western Reserve University-র Associate Professor of Anthropology এবং হরপ্পা (সিন্ধু) সভ্যতার দীর্ঘকালীন গবেষক ও পুরাতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিক Jim G. Shaffer বলেছেন, ৭০০০ খ্রিঃপূঃতে বালুচিস্তানে, সিন্ধু নদ উপত্যকার মেহেরগড় নামক অঞ্চলে প্রথম গ্রাম গড়ে ওঠার সবরকমের প্রমাণ বিদ্যমান এবং এই গ্রামীন সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি। সেই সময় কোন বিদেশী অনুপ্রবেশের চিহ্ন পুরাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বে পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রায় ৭০০০ খ্রিঃপূঃতে মেহেরগড় অঞ্চল থেকে শুরু হয়ে কোট দিজি, সোথি, গুমলা প্রভৃতি আদি হরপ্পা পর্যায়ের উন্নতমানের সংস্কৃতি পার হয়ে ক্রমশ ৮০০০ বর্গ কিমি জুড়ে হরপ্পা সভ্যতা (প্রসঙ্গত, হরপ্পা সভ্যতার পূর্ণ বিকাশকাল বা Mature phase হল ২৬০০ খ্রিঃপূঃ - ১৯০০ খ্রিঃপূঃ) গড়ে উঠেছিল, যা একান্তভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতার পুরাবস্তুতে লোহার অস্ত্র বা সরঞ্জামের এবং ঘোড়া ও ঘোড়ায় টানা রথের অস্তিত্ত্ব যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনই কিছু দাবি সত্ত্বেও হরপ্পার লিপির পাঠোদ্ধার আজও করা যায়নি ফলত হরপ্পা সভ্যতার ভাষাটি (প্রসঙ্গত, বর্তমানে হরপ্পা সভ্যতার বিস্তৃতি দেখে অনুমিত হয়, একাধিক ভাষার অস্তিত্ব ছিল) জানা যায়নি এবং হরপ্পা সভ্যতায় কোন বংশানুক্রমিক নেতৃত্বও ছিলনা। (প্রসঙ্গত, হরপ্পার নাগরিক সভ্যতার পতন হয়েছিল ১৯০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ।)
অপরদিকে বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে পুরাতাত্ত্বিক ‘চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র' সংস্কৃতি বা Painted Grey Ware (PGW) Culture। PGW সংস্কৃতিতে লোহার অস্ত্রের ব্যবহার, ঘোড়ার অস্তিত্ব, মাটির বাড়িঘর, কাঠ ও মাটি দিয়ে তৈরী ঘরবাড়ি পাওয়া গেছে। (প্রসঙ্গত, পূর্ব হরিয়ানা, গঙ্গা-যমুনা দোয়াব ও উচ্চগাঙ্গেয় সমভূমিতে এই PGW সংস্কৃতি লক্ষ্য করা গেছে ১০০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ৫০০ খ্রিঃপূঃ পর্যন্ত। পুরাতত্ত্বের ভাষায় কাঠ ও মাটি দিয়ে তৈরী ঘরবাড়িকে wattle and daub বলা হয়। PGW পর্যায়ে কোন আগুনে পোড়ানো ইঁট দিয়ে তৈরি বাড়ির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই অঞ্চলে আগুনে পোড়ানো ইঁট দিয়ে তৈরি বাড়ির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে PGW-র পরের পর্যায়, Northern Black Polished Ware (NBPW) Culture বা 'উত্তরের কালো উজ্জ্বল মৃৎপাত্র' সংস্কৃতিতে, যার সময় নির্ধারিত হয়েছে ৬০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ২০০ খ্রিঃপূঃ পর্যন্ত এবং এই সময়েই গঙ্গা-যমুনা অঞ্চলে ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় নগরায়ন ঘটে।) বৈদিক সংস্কৃতিতে ভাষা হিসাবে সংস্কৃত ভাষাকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে ও এই সংস্কৃতিতে বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের পরম্পরা আছে এবং চতুর্বর্ণ নামক সামাজিক বিভাগ আছে। এই সবগুলি বৈশিষ্ট্যই হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থান করছে। সুতরাং হাজারবার দাবি করলেও বৈদিক গোষ্ঠীদের দ্বারা হরপ্পা সভ্যতা কোনভাবেই গড়ে ওঠেনি।
এর সঙ্গে যা তিনি যোগ করেছেন, তা হল, ভারতে আদৌ কোন বিদেশী আর্যদের আক্রমণ ঘটেনি। পুরাতাত্ত্বিক PGW সংস্কৃতি, যাকে বিদেশী আর্য সংস্কৃতি বলে এতদিন চিহ্নিত করা হয়ে এসেছে, সেই সংস্কৃতির চিহ্ন বিশিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী ১০০০ খ্রিঃপূঃ- র আগে পূর্ব ভারতে ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় খুঁজে পেয়েছেন। এমনকি একসময় বলা হত লোহার অস্ত্র ও সরঞ্জামের আগমণ ১৫০০ খ্রিঃপূঃতে বিদেশ থেকে আগত আর্যদের হাত ধরে ভারতের বাইরে থেকে এসেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে আকরিক থেকে লৌহ ধাতুর নিষ্কাশন পদ্ধতির আবিস্কার ও লৌহপ্রযুক্তির প্রাথমিক পর্যায় প্রায় ১৭০০ খ্রিঃপূঃতে ভারতের অভ্যন্তরেই ঘটেছে। যদিও ভারতে পূর্ণরূপে লৌহযুগ (Iron Age) শুরু হয়েছে ৮০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ।
সুতরাং, এটাও যেমন বলা যায়না যে, বৈদিক গোষ্ঠী হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তুলেছে, তেমন এটাও বলা যায়না যে, PGW সংস্কৃতি, যা বৈদিক গোষ্ঠীদের নিজস্ব সংস্কৃতি, তা বিদেশ থেকে ঔপনিবেশিক প্রভূদের মস্তিষ্ক-সঞ্জাত আর্য নামক এক বিশেষ জাতি দ্বারা আমদানীকৃত। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে যেটা বলা যায়, সেটা হল এই দুটি সংস্কৃতিই ভারতের দুটি আলাদা সামাজিক গোষ্ঠীর সংস্কৃতি।
এরপরই ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে Shaffer প্রশ্ন তুলেছেন, ‘Did Aryans exist?’
উপসংহার
--------------
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানকালে বৈদিক সাহিত্যের অস্তিত্ব সত্য কিন্তু সেই সাহিত্যকে ভিত্তি করে ভারতের হাজার বছরের (১৫০০ খ্রিঃপূঃ - ৬০০ খ্রিঃপূঃ) সম্পূর্ণ ইতিহাস কী রচনা করা যায়?
আমরা যেটুকু জানলাম, তাতে বলা যায়, না, সম্পূর্ণ ইতিহাস কখনই রচনা করা যায় না। বেদ কবে রচিত হয়েছিল তার কোন অকাট্য প্রমাণ নেই। বেদগুলির সংকলনের মূল পুঁথিগুলির কোন হদিশ নেই। ভাষাতত্ত্ব নামক এক ছদ্ম-বিজ্ঞান (Pseudo-science) কে ভিত্তি করে বলা হয়, বেদ রচনার শুরু হয়েছিল, ১৫০০ খ্রিঃপূঃ তে। বেদগুলি যে খ্রিষ্টিয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে রচনা করা হয়নি, তাই বা কে বলতে পারে! বেদগুলির কোন অংশটি প্রাচীন, কোনটি নবীন, কোনটি প্রক্ষিপ্ত তার কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র ও প্রমাণ নেই। বরং বলা যায়, প্রাচীনকালে বৈদিক সাহিত্যকে ভিত্তি করে ভারতে উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক বিশাল Myth সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এই Myth-এর ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চবর্ণের বংশ পরম্পরায় সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার ও শাসন-শোষনের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল। ব্রিটিশরা হিন্দু উচ্চবর্ণদের নিজেদের দলে টেনে নিতে সেই Myth-এর ওপর ভিত্তি করে ভারতের ইতিহাসের প্রায়-পর্যায়ের এক মিথ্যা ইতিহাস রচনা করেছিল। আশ্চর্যের কিছু নয়, আপনি শাসক হলে আপনিও হয়তো একই পরিকল্পনা করতেন।
জীববিদ্যা-নৃতাত্বিকগণ (Biological-Anthropologists) উপমহাদেশে আর্য জাতির শারীরিক ও জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য (Biological and Demographic Features) সম্পর্কে কোন তথ্য ও তত্ত্ব দিতে না পারলেও, ‘আর্য জাতি’ (Aryan Race) ও 'তৎসম্ভূত উচ্চবর্ণের' প্রতি সম্ভ্রমের শেকড় ভারতের নাগরিকদের চেতন ও অবচেতনে গভীরভাবে প্রোথিত। এত সহজে তা ওপড়াবে কে?
ভারতীয় সংস্কৃতিতে বৈদিক সাহিত্যের অবদান সত্য, কিন্তু নিচের পুরাতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিক তথ্যগুলি বৈদিক সাহিত্যের আর্যায়ণ সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে -
১) উপমহাদেশের কোন বিশেষ ভূখন্ড ও সংস্কৃতির আর্যায়ন (Aryanism) করা যাচ্ছে না,
২) প্রাগৈতিহাসিক যুগের তথাকথিত আর্য সমাধির শারীরিক অবশেষের নমুনাগুলির (Specimens of human remains) সঙ্গে তথাকথিত অনার্য সমাধির শারীরিক অবশেষের নমুনাগুলির কোন নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না,
৩) উপমহাদেশের প্রাগৈতিহাসিক শারীরিক অবশেষের নমুনাগুলির সঙ্গে মিশর, আনাতোলিয়া (তুরস্ক ও সিরিয়া), মেসোপটেমিয়া (ইরাক) ও ইরানের প্রাগৈতিহাসিক শারীরিক অবশেষের নমুনাগুলির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং
৪) ভারতের প্রাগৈতিহাসিক পুরাক্ষেত্রগুলি থেকে সংগৃহীত শারীরিক অবশেষের নমুনা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে বহিরাগত জাতির কোন বিপুল অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
সুতরাং বিদেশ থেকে আগত আর্যজাতি আর ভারতীয় বৈদিক গোষ্ঠীকে পৃথক করার সময় এসে গেছে।
উপমহাদেশে জিনগত বা পরিবেশগত অথবা দুটির মিলিত কারণে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য (Phenotypic pattern) অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে এবং তা জীববিদ্যা-নৃতাত্বিকগণের গবেষণায় উঠে এসেছে, এটা সত্য। কিন্তু বৈশিষ্ট্যগত বিতরণ মানচিত্র (Trait Distribution Map) থেকে যদি ধারণাও হয় যে উপমহাদেশের দুটি শারীরিক নমুনার মধ্যে 'বিজাতীয় পার্থক্য' আছে, বাস্তবে কিন্তু দেখা যায়, শারীরিক পার্থক্যের ক্রমবিন্যাসটি 'ভৌগলিক ও পরিবেশগত বৈচিত্রের' কারণে সৃষ্ট।
উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে একমুখী জিন প্রবাহ অন্তর্ভাগে ঘটতেই পারে কিন্তু তা ছোটমাপের পরিযানগত (small scale migration) কারণে। যেমন, হরপ্পার নাগরিক সভ্যতার যুগে বাণিজ্যিক কারণে কিছু বিদেশীর আগমণ ও সেই স্থানে হরপ্পীয় নারীদের সঙ্গে তাদের বিবাহ, সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি স্বাভাবিক ঘটনা হতেই পারে, কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক সময়ে, বিশেষ করে ১৫০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ ধারাবাহিকভাবে বিদেশীদের দলে দলে ভারতে অনুপ্রবেশের কোন পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক তথ্য সুদীর্ঘ গবেষণায় পাওয়া যায়নি, তাই ‘আর্য আক্রমণ বা আগমণ তত্ত্ব’ সমর্থন করার কোন কারণ নেই।
স্বর্ণকেশ, নীল বা ধূসর রঙের চোখের মণি, হালকা রঙের ত্বক, টিকালো নাসিকা, দীর্ঘায়ত মুখাবয়ব ইত্যাদি যদি আর্য বা তৎসম্ভূত উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে বলতে হয় এই শারীরিক বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সব প্রান্তেই লক্ষ্য করা যায়, অথচ পৃথিবীর সব প্রান্তে তো ইওরোপ থেকে আর্য পরিযাণ (Aryan Migration) ঘটেনি। তাহলে?
তামিল ব্রাহ্মণ বা কেরলের নাম্বুদ্রিপাদদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য কি তথাকথিত আর্যসম, না কি দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য মানুষদের, এমনকি নিম্নবর্ণের মানুষদের সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন? কোন উত্তর মেলেনা ভারতে আর্যায়নের সমর্থকদের কাছ থেকে। তাহলে ব্রাহ্মণ বলে যদি কোন বিশেষ শারীরিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতই করা না যায়, তাহলে কি করে বলা যাবে যে তারা ‘আর্য জাতিসম্ভূত’?
আর্য জাতি তত্ত্ব যে একান্তভাবেই ইওরোপীয়ান ঔপনিবেশকারীদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র তা নিয়ে বর্তমানে কোন সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় এই জাতি তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবেই বাতিলের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলতেই পারি, বর্তমান সময়ে আর্য জাতি তত্ত্ব (Aryan Race Theory) হল ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ (Living fossils)।
ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে জীববিদ্যা-নৃতাত্বিকগণ (Biological-Anthropologist) প্রশ্ন তুলেছেন, ‘How could one recognize an Aryan, living or dead, when the biological criteria for Aryanness are non-existent?’
এই প্রশ্ন সর্বসমক্ষে তুলে ধরার মালিকানা এখন আপনার হাতে, আপনি তা তুলে ধরবেন কিনা, সেটাই মহার্ঘ জিজ্ঞাসা।
।। সমাপ্ত ।।
ঋণ স্বীকার:-
1. Chakrabarti, Dilip K., 'India An Archeological History, Palaeolithic Beginnings to Early Historic Foundations', Oxford University Press, 2001.
2. Hemphill, B.E., Lukacs, J.R. and Kennedy, K.A.R., 'Biological Adaptations and Affinities of the Bronze Age Harappans', In 'Harappa Excavations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millenium Urbanism', R. Meadow (ed.), Madison, Prehistory Press, 1991.
3. Leach, E, 'Aryan Invasions Over Four Millenia', in 'Culture Through Time, Anthropological Approaches', E. Ohnuki-Tierney (ed.), Stanford University Press, 1990.
4. Mushrif-Tripathi, Veena, 'Human Skeletal Studies in India: A Review', in 'Archaeological Human Remains: Global Perspectives', Barra O'Donnabhain (ed.), Springer, 2014.
5. Shaffer, Jim G. and Lichtenstein, Diane A., 'South Asian Archaeology and the Myth of Indo-Aryan Invasion', in 'The Indo-Aryan Controversy, Evidence and Inference in Indian History', Edwin F. Bryant and Laurie, L. Patton (eds.), Routledge, 2005.
================================
২য় পর্বের লিংক -
https://www.facebook.com/groups/sukumarray/permalink/2352187834796562/
রিসলে ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞের মতামত
----------------------------------------------------
ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকার্যের শুরুতেই ব্রিটিশরা বুঝেছিল, যেহেতু শাসক সম্প্রদায় মূলত মুসলমান, তাই ভারতের উচ্চবর্গের (উচ্চবর্ণীয়) হিন্দুদের নিজেদের দলে টানতে হবে, নাহলে শাসন-শোষণ চালানো মুশকিল। তাই এমন এক পুরাকথা মিশ্রিত ইতিহাস (Mythical history) তৈরি করতে হবে যেখানে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরাই সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে থাকবে। তাই, সেই ইতিহাস ‘took shape when brown sahibs and white sahibs sought to escape their fears about the instability of social hierarchy by giving it a biological basis and projecting it into the past - thus covering extant hierarchies with the mantle of the natural and the primordial’. (Guha S., ‘Lower Starta, Older Races And Aboriginal Peoples: Racial Anthropology And Mythical History Past And Present’, The Journal of Asian Studies, 57(2), 1998, pp. 423-41.)
১৯০১ সালে ব্রিটিশ ভারতের কমিশনার অফ সেনসাস পদে নিযুক্ত হলেন H.H. Risley মহাশয়। তিনি তাঁর অফিসারদের দিয়ে সারা ভারতের নৃতাত্ত্বিক তথ্য যোগাড় করে(!) ১৯০৮ সালে একটি রিপোর্ট খাড়া করলেন। সেই রিপোর্টে জানালেন, তিনি ভারতের মানুষদের মধ্যে সাত রকমের জাতিভাগ (Racial Category) পেয়েছেন: তুর্ক-ইরানিয়ান, ইন্দো-এরিয়ান, সিথো-দ্রাবিড়িয়ান, আর্য-দ্রাবিড়িয়ান, মঙ্গোল-দ্রাবিড়িয়ান, মঙ্গোলয়েড এবং দ্রাবিড়িয়ান। রিসলের রিপোর্ট জানাল, উত্তরভারতের ব্রাহ্মণ ও উচ্চ বর্ণের মানুষদের মধ্যেই দীর্ঘ মস্তক-বিশিষ্ট (Dolichocephalic or Long-headed) বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে এবং এঁরাই হলেন বহুদিন পূর্বে আগত শ্রেষ্ঠ আর্য জাতির বংশধর। রিসলের মস্তিস্কে নিশ্চয়ই দুটি বিষয় কাজ করেছিল, ১) নিজ বর্ণের মধ্যে বিবাহ সংক্রান্ত সামাজিক কড়া প্রথা এবং ২) পেশাগত বৈশিষ্ট্য (একজন ব্রাহ্মণ কি অন্যের ব্যবহৃত, ছেঁড়া পাদুকা সেলাই-এর কাজ করত নাকি মাথায় করে অন্যের গুয়ের হাঁড়ি বয়ে নিয়ে যেত?)।
রিসলের তত্ত্ব নিয়ে আপত্তি উঠল এই কারণে যে, উত্তরভারতের সকল ব্রাহ্মণরাই দীর্ঘ মস্তক-বিশিষ্ট নয় এবং সুদূর মঙ্গোলিয়ান ও ভারতীয় আদিবাসীদের বৈশিষ্ট্যও তাদের মধ্যে বিদ্যমান। পশ্চিম ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র এবং পুব ভারতের বাংলা, উড়িষ্যায় প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ পাওয়া যাচ্ছে ভুরি ভুরি। আবার উল্টোদিকে দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলা মানুষদের মধ্যে দীর্ঘ মস্তক-বিশিষ্ট মানুষও পাওয়া যাচ্ছে। রিসলে এই ধাঁধার উত্তরে সপাটে জানালেন, এটি যৌন সংকরায়নের ফলে ঘটেছে।
রিসলের তত্ত্বের বিরোধিতা করে R.P. Chanda ১৯১৬ সালে তাঁর ‘The Indo-Aryan Races’ বইতে পরিস্কারভাবে জানালেন, ব্রাহ্মণরাই শ্রেষ্ঠ জাতি (বর্ণ), সে তারা দীর্ঘ অথবা প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট যাই হোক না কেন। তিনি জানালেন আদৌ কোনরকম যৌন সঙ্করায়ন হয়নি। প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট আর্যদের উৎপত্তিস্থল সিন্ধু নদের ওপারের বালুচিস্তান এবং আফগানিস্তান। এখানকার Aryan/Iranian ভাষায় কথা বলা মানুষরাই সিন্ধু পেরিয়ে এদিকে এসেছিল এবং এদের থেকেই প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট ব্রাহ্মণদের ধারা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট বাঙালী ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চ বর্ণের বাঙালীদের উৎপত্তির মূল আদৌ মঙ্গোলয়েড জাতি নয় বরং তাকলামাকান মরুভূমি থেকে আগত বিশিষ্ট ও উচ্চ মানের আর্য জাতি।
১৯৩১ সালের সেনসাস রিপোর্টে কিছু পরিবর্তন এল। তার ভিত্তিতে নৃতত্ববিদ B.S. Guha জানালেন, ভারতের ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষদের মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় দীর্ঘ মস্তক-বিশিষ্ট ও আল্পীয় প্রশস্ত মস্তক-বিশিষ্ট মানুষদের বৈশিষ্ট্যের মিলন ঘটেছে। গুহ আরও জানালেন, বৈদিক আর্য জাতির আরো কিছু বিশিষ্টতা আছে। যেমন, শারীরিক দৈর্ঘতা, খাড়া বা টিকালো নাসিকা, দীর্ঘায়ত মুখাবয়ব, গৌরবর্ণ ইত্যাদি।
আর্য জাতির এই ধাঁচ নিয়ে এবং এভাবে জাতি নির্ধারণ করা নিয়ে বিশিষ্ট Racial Paleontologists A.C. Huddon, J.H. Hutton, G.M. Mortant, F.V. Luschan, E. Fischer, E.V. Eickstedt, A.K. Mitra, D.N. Majumdar, P.C. Dutta প্রমুখ তুমুল আপত্তি জানালেন।
সেইসব আপত্তিকে পাশে সরিয়ে রেখে ব্রিটিশ প্রভূরা আর্য জাতি সম্ভূত হিন্দু উচ্চবর্ণের মানুষদের দলে টানা শুরু করল। ব্রিটিশ প্রভূ ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির 'আয় ভাই কানাই-আয় ভাই বলাই, তোকে বুকে জড়িয়ে বগল বাজাই' প্রভাব লক্ষ্য করা গেল যখন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ না দিয়ে, স্বতন্ত্র হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করার চেষ্টা শুরু করল।
১৯৯১ সালের বায়োলজিকাল অ্যানথ্রপোলজির গবেষণাপত্র
-----------------------------------------------------------------
১৯৯১ সালে Hemphill, Lukacs এবং Kennedy-র প্রকাশিত গবেষণাপত্র (*) জানাল যে, তথাকথিত আর্য অধ্যুষিত গান্ধার এবং তথাকথিত অনার্য অধ্যুষিত হরপ্পা অধিবাসীদের করোটির মাপজোক (Craniometric), দাঁতের গড়ন ও মাপ (Odontometric) এবং অসম্বদ্ধ প্রলক্ষণ (Discrete Trait) এর বৈশিষ্ট্য বিচার করে তাঁরা দেখেছেন, এই দুই জায়গার অধিবাসীদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য আছে।
প্রাগৈতিহাসিক ও বর্তমান পাকিস্তান এবং প্রাগৈতিহাসিক মিশর, আনাতোলিয়া, মেসোপটেমিয়া ও ইরানের মালভূমি অঞ্চলের করোটি ও কংকালের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের নমুনার তুলনামূলক বিচারও এই গবেষণায় করা হয়েছে। তাঁরা লক্ষ্য করেছেন সমগ্র সিন্ধু উপত্যকার প্রাগৈতিহাসিক এবং বর্তমানকালের নমুনাগুলির (শুধুমাত্র মহেঞ্জোদারো অঞ্চল ব্যতিক্রমী) মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে। হরপ্পার দুটি বিখ্যাত সমাধিস্থল, Cemetery R-37 এবং Cemetery H-এর কংকালের নমুনার মধ্যেও যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। আবার একই সাদৃশ্য তথাকথিত আর্য অধিকৃত গান্ধারের তিমরগড়ার সমাধিক্ষেত্রেও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, উপমহাদেশের প্রাগৈতিহাসিক নমুনাগুলির সঙ্গে মিশর, আনাতোলিয়া, মেসোপটেমিয়া ও ইরানের প্রাগৈতিহাসিক নমুনাগুলির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এরপর তাঁরা যে তথ্য পেশ করলেন, তা বিস্ফোরন ঘটালো ভারতের ইতিহাসে। তাঁরা বললেন, প্রাগৈতিহাসিক যুগে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে দুটিমাত্র জনতাত্ত্বিক বৈসাদৃশ্য (Demographic discontinuities) পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমটি হল, ৬০০০ থেকে ৪৫০০ খ্রিঃপূঃ-র মধ্যে (অর্থাৎ মেহেরগড়ের নব্যপ্রস্তর ও তাম্রপ্রস্তর যুগের সমকালীন) দ্বিতীয়টি ৮০০ খ্রিঃপূঃ-র পরে (ভারতীয় ইতিহাস অনুযায়ী যে সময়কে 'পরবর্তী বৈদিক যুগ' বলা হয়)।
পরিস্কারভাবে বললে বলতে হয়, হরপ্পার (সিন্ধু) নাগরিক সভ্যতার পতন (১৯০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ) -এর পরে ১৫০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ ভারতের বাইরে থেকে হিন্দুকুশ টপকে, ঘোড়ায় চেপে হা-রে-রে করতে করতে লৌহ অস্ত্রাদি সজ্জিত, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যদু, তুর্বশ, অনু, দ্রুহ, পুরু, ভরত প্রভৃতি গোষ্ঠীর আর্য ঋষি-মুনিদের চ্যালা-চামুন্ডা নিয়ে কিছু সময়ের ব্যবধানে দলে দলে ভারত আক্রমণ/আগমনের তত্ত্ব (Aryan Invasion/Migration Theory) এবং ভারতে এসে আর্য মশালের আলো জ্বালিয়ে ভারতের অসভ্য, বর্বর অন্-আর্যদের সভ্যতার আলো দেখানোর তত্ত্ব স্রেফ হাওয়ায় উড়ে গেল। একইসঙ্গে ধ্বসে পড়ল তথাকথিত আর্য জাতির মহিমা ও গরিমা। বাইরে থেকে যদি কেউ এসেও থাকে, হয় ৪৫০০ খ্রিঃপূঃ-র আগে এসেছে নয়তো ৮০০ খ্রিঃপূঃ পরে এসেছে।
তা’হলে? ঔপনিবেশিক ভাষাতত্ত্ব ঘেঁটে ঘ!!!
(*) গবেষণাটি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল অবধি নিম্নলিখিত তিনজন সম্পন্ন করেছিলেন -
1. Brian E. Hemphill, Associate Professor, Dept. of Anthroplogy, University of Alaska Fairbanks, Alaska, USA.
2. John R. Lukacs, Professor, Dept. of Anthropolgy, University of Oregon, Eugene, Oregon, USA.
3. Kenneth Adrian Raine Kennedy, Ex. Professor Emeritus of Ecology and Evolutionary Biology, Anthropology and Asian Studies in the Division of Biological Sciences at Cornell University, New York, USA.
একদল ঐতিহাসিকের হইচই
---------------------------------------
এই গবেষণাপত্র প্রকাশিত হওয়ার পরে ভারতের একদল ঐতিহাসিক হইচই করে উঠলেন। তাঁরা বললেন, আমরা তো আগেই বলেছিলাম –
১) বৈদিক-আর্য সভ্যতা বহু বহু প্রাচীন, সম্পূর্ণ এক ভারতীয় সভ্যতা,
২) ঋগ্বেদ অন্তত ৫০০০ খ্রিঃপূঃতে রচিত,
৩) সেই কারনেই বৈদিক সাহিত্যে গ্রামীণ সংস্কৃতির কথা বলা আছে,
৪) বেদ রচনার পরবর্তীকালে এই আর্যদের হাতেই ধীরে ধীরে হরপ্পার নাগরিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল,
৫) এই ভারতীয় আর্যরাই ভারতে সভ্যতার আলো জ্বালিয়েছিল,
৬) এই ভারতীয় আর্যরাই ক্রমশ পুব থেকে পশ্চিমে গিয়ে ইরানে জেন্দ-আবেস্তা লিখেছিল, ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে মিত্তানি সভ্যতার পত্তন করে দিনে পাঁচবার সূর্য নমস্কার প্রথা শুরু করেছিল (যার ফলশ্রুতিতে, পরবর্তীকালে ইসলামে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রথা) ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য জাতির অস্তিত্ত্ব
----------------------------------------------------------
Case Western Reserve University-র Associate Professor of Anthropology এবং হরপ্পা (সিন্ধু) সভ্যতার দীর্ঘকালীন গবেষক ও পুরাতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিক Jim G. Shaffer বলেছেন, ৭০০০ খ্রিঃপূঃতে বালুচিস্তানে, সিন্ধু নদ উপত্যকার মেহেরগড় নামক অঞ্চলে প্রথম গ্রাম গড়ে ওঠার সবরকমের প্রমাণ বিদ্যমান এবং এই গ্রামীন সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি। সেই সময় কোন বিদেশী অনুপ্রবেশের চিহ্ন পুরাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বে পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রায় ৭০০০ খ্রিঃপূঃতে মেহেরগড় অঞ্চল থেকে শুরু হয়ে কোট দিজি, সোথি, গুমলা প্রভৃতি আদি হরপ্পা পর্যায়ের উন্নতমানের সংস্কৃতি পার হয়ে ক্রমশ ৮০০০ বর্গ কিমি জুড়ে হরপ্পা সভ্যতা (প্রসঙ্গত, হরপ্পা সভ্যতার পূর্ণ বিকাশকাল বা Mature phase হল ২৬০০ খ্রিঃপূঃ - ১৯০০ খ্রিঃপূঃ) গড়ে উঠেছিল, যা একান্তভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব সভ্যতা। হরপ্পা সভ্যতার পুরাবস্তুতে লোহার অস্ত্র বা সরঞ্জামের এবং ঘোড়া ও ঘোড়ায় টানা রথের অস্তিত্ত্ব যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনই কিছু দাবি সত্ত্বেও হরপ্পার লিপির পাঠোদ্ধার আজও করা যায়নি ফলত হরপ্পা সভ্যতার ভাষাটি (প্রসঙ্গত, বর্তমানে হরপ্পা সভ্যতার বিস্তৃতি দেখে অনুমিত হয়, একাধিক ভাষার অস্তিত্ব ছিল) জানা যায়নি এবং হরপ্পা সভ্যতায় কোন বংশানুক্রমিক নেতৃত্বও ছিলনা। (প্রসঙ্গত, হরপ্পার নাগরিক সভ্যতার পতন হয়েছিল ১৯০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ।)
অপরদিকে বৈদিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে পুরাতাত্ত্বিক ‘চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্র' সংস্কৃতি বা Painted Grey Ware (PGW) Culture। PGW সংস্কৃতিতে লোহার অস্ত্রের ব্যবহার, ঘোড়ার অস্তিত্ব, মাটির বাড়িঘর, কাঠ ও মাটি দিয়ে তৈরী ঘরবাড়ি পাওয়া গেছে। (প্রসঙ্গত, পূর্ব হরিয়ানা, গঙ্গা-যমুনা দোয়াব ও উচ্চগাঙ্গেয় সমভূমিতে এই PGW সংস্কৃতি লক্ষ্য করা গেছে ১০০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ৫০০ খ্রিঃপূঃ পর্যন্ত। পুরাতত্ত্বের ভাষায় কাঠ ও মাটি দিয়ে তৈরী ঘরবাড়িকে wattle and daub বলা হয়। PGW পর্যায়ে কোন আগুনে পোড়ানো ইঁট দিয়ে তৈরি বাড়ির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এই অঞ্চলে আগুনে পোড়ানো ইঁট দিয়ে তৈরি বাড়ির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে PGW-র পরের পর্যায়, Northern Black Polished Ware (NBPW) Culture বা 'উত্তরের কালো উজ্জ্বল মৃৎপাত্র' সংস্কৃতিতে, যার সময় নির্ধারিত হয়েছে ৬০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ২০০ খ্রিঃপূঃ পর্যন্ত এবং এই সময়েই গঙ্গা-যমুনা অঞ্চলে ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় নগরায়ন ঘটে।) বৈদিক সংস্কৃতিতে ভাষা হিসাবে সংস্কৃত ভাষাকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে ও এই সংস্কৃতিতে বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের পরম্পরা আছে এবং চতুর্বর্ণ নামক সামাজিক বিভাগ আছে। এই সবগুলি বৈশিষ্ট্যই হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থান করছে। সুতরাং হাজারবার দাবি করলেও বৈদিক গোষ্ঠীদের দ্বারা হরপ্পা সভ্যতা কোনভাবেই গড়ে ওঠেনি।
এর সঙ্গে যা তিনি যোগ করেছেন, তা হল, ভারতে আদৌ কোন বিদেশী আর্যদের আক্রমণ ঘটেনি। পুরাতাত্ত্বিক PGW সংস্কৃতি, যাকে বিদেশী আর্য সংস্কৃতি বলে এতদিন চিহ্নিত করা হয়ে এসেছে, সেই সংস্কৃতির চিহ্ন বিশিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী ১০০০ খ্রিঃপূঃ- র আগে পূর্ব ভারতে ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় খুঁজে পেয়েছেন। এমনকি একসময় বলা হত লোহার অস্ত্র ও সরঞ্জামের আগমণ ১৫০০ খ্রিঃপূঃতে বিদেশ থেকে আগত আর্যদের হাত ধরে ভারতের বাইরে থেকে এসেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক কালের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে আকরিক থেকে লৌহ ধাতুর নিষ্কাশন পদ্ধতির আবিস্কার ও লৌহপ্রযুক্তির প্রাথমিক পর্যায় প্রায় ১৭০০ খ্রিঃপূঃতে ভারতের অভ্যন্তরেই ঘটেছে। যদিও ভারতে পূর্ণরূপে লৌহযুগ (Iron Age) শুরু হয়েছে ৮০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ।
সুতরাং, এটাও যেমন বলা যায়না যে, বৈদিক গোষ্ঠী হরপ্পা সভ্যতা গড়ে তুলেছে, তেমন এটাও বলা যায়না যে, PGW সংস্কৃতি, যা বৈদিক গোষ্ঠীদের নিজস্ব সংস্কৃতি, তা বিদেশ থেকে ঔপনিবেশিক প্রভূদের মস্তিষ্ক-সঞ্জাত আর্য নামক এক বিশেষ জাতি দ্বারা আমদানীকৃত। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে যেটা বলা যায়, সেটা হল এই দুটি সংস্কৃতিই ভারতের দুটি আলাদা সামাজিক গোষ্ঠীর সংস্কৃতি।
এরপরই ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে Shaffer প্রশ্ন তুলেছেন, ‘Did Aryans exist?’
উপসংহার
--------------
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমানকালে বৈদিক সাহিত্যের অস্তিত্ব সত্য কিন্তু সেই সাহিত্যকে ভিত্তি করে ভারতের হাজার বছরের (১৫০০ খ্রিঃপূঃ - ৬০০ খ্রিঃপূঃ) সম্পূর্ণ ইতিহাস কী রচনা করা যায়?
আমরা যেটুকু জানলাম, তাতে বলা যায়, না, সম্পূর্ণ ইতিহাস কখনই রচনা করা যায় না। বেদ কবে রচিত হয়েছিল তার কোন অকাট্য প্রমাণ নেই। বেদগুলির সংকলনের মূল পুঁথিগুলির কোন হদিশ নেই। ভাষাতত্ত্ব নামক এক ছদ্ম-বিজ্ঞান (Pseudo-science) কে ভিত্তি করে বলা হয়, বেদ রচনার শুরু হয়েছিল, ১৫০০ খ্রিঃপূঃ তে। বেদগুলি যে খ্রিষ্টিয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে রচনা করা হয়নি, তাই বা কে বলতে পারে! বেদগুলির কোন অংশটি প্রাচীন, কোনটি নবীন, কোনটি প্রক্ষিপ্ত তার কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র ও প্রমাণ নেই। বরং বলা যায়, প্রাচীনকালে বৈদিক সাহিত্যকে ভিত্তি করে ভারতে উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক বিশাল Myth সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং এই Myth-এর ওপর দাঁড়িয়ে উচ্চবর্ণের বংশ পরম্পরায় সমাজে নেতৃত্ব দেওয়ার ও শাসন-শোষনের পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল। ব্রিটিশরা হিন্দু উচ্চবর্ণদের নিজেদের দলে টেনে নিতে সেই Myth-এর ওপর ভিত্তি করে ভারতের ইতিহাসের প্রায়-পর্যায়ের এক মিথ্যা ইতিহাস রচনা করেছিল। আশ্চর্যের কিছু নয়, আপনি শাসক হলে আপনিও হয়তো একই পরিকল্পনা করতেন।
জীববিদ্যা-নৃতাত্বিকগণ (Biological-Anthropologists) উপমহাদেশে আর্য জাতির শারীরিক ও জনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য (Biological and Demographic Features) সম্পর্কে কোন তথ্য ও তত্ত্ব দিতে না পারলেও, ‘আর্য জাতি’ (Aryan Race) ও 'তৎসম্ভূত উচ্চবর্ণের' প্রতি সম্ভ্রমের শেকড় ভারতের নাগরিকদের চেতন ও অবচেতনে গভীরভাবে প্রোথিত। এত সহজে তা ওপড়াবে কে?
ভারতীয় সংস্কৃতিতে বৈদিক সাহিত্যের অবদান সত্য, কিন্তু নিচের পুরাতাত্ত্বিক-নৃতাত্ত্বিক তথ্যগুলি বৈদিক সাহিত্যের আর্যায়ণ সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে -
১) উপমহাদেশের কোন বিশেষ ভূখন্ড ও সংস্কৃতির আর্যায়ন (Aryanism) করা যাচ্ছে না,
২) প্রাগৈতিহাসিক যুগের তথাকথিত আর্য সমাধির শারীরিক অবশেষের নমুনাগুলির (Specimens of human remains) সঙ্গে তথাকথিত অনার্য সমাধির শারীরিক অবশেষের নমুনাগুলির কোন নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না,
৩) উপমহাদেশের প্রাগৈতিহাসিক শারীরিক অবশেষের নমুনাগুলির সঙ্গে মিশর, আনাতোলিয়া (তুরস্ক ও সিরিয়া), মেসোপটেমিয়া (ইরাক) ও ইরানের প্রাগৈতিহাসিক শারীরিক অবশেষের নমুনাগুলির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং
৪) ভারতের প্রাগৈতিহাসিক পুরাক্ষেত্রগুলি থেকে সংগৃহীত শারীরিক অবশেষের নমুনা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে বহিরাগত জাতির কোন বিপুল অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।
সুতরাং বিদেশ থেকে আগত আর্যজাতি আর ভারতীয় বৈদিক গোষ্ঠীকে পৃথক করার সময় এসে গেছে।
উপমহাদেশে জিনগত বা পরিবেশগত অথবা দুটির মিলিত কারণে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য (Phenotypic pattern) অবশ্যই পাওয়া যাচ্ছে এবং তা জীববিদ্যা-নৃতাত্বিকগণের গবেষণায় উঠে এসেছে, এটা সত্য। কিন্তু বৈশিষ্ট্যগত বিতরণ মানচিত্র (Trait Distribution Map) থেকে যদি ধারণাও হয় যে উপমহাদেশের দুটি শারীরিক নমুনার মধ্যে 'বিজাতীয় পার্থক্য' আছে, বাস্তবে কিন্তু দেখা যায়, শারীরিক পার্থক্যের ক্রমবিন্যাসটি 'ভৌগলিক ও পরিবেশগত বৈচিত্রের' কারণে সৃষ্ট।
উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে একমুখী জিন প্রবাহ অন্তর্ভাগে ঘটতেই পারে কিন্তু তা ছোটমাপের পরিযানগত (small scale migration) কারণে। যেমন, হরপ্পার নাগরিক সভ্যতার যুগে বাণিজ্যিক কারণে কিছু বিদেশীর আগমণ ও সেই স্থানে হরপ্পীয় নারীদের সঙ্গে তাদের বিবাহ, সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি স্বাভাবিক ঘটনা হতেই পারে, কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক সময়ে, বিশেষ করে ১৫০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ ধারাবাহিকভাবে বিদেশীদের দলে দলে ভারতে অনুপ্রবেশের কোন পুরাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক তথ্য সুদীর্ঘ গবেষণায় পাওয়া যায়নি, তাই ‘আর্য আক্রমণ বা আগমণ তত্ত্ব’ সমর্থন করার কোন কারণ নেই।
স্বর্ণকেশ, নীল বা ধূসর রঙের চোখের মণি, হালকা রঙের ত্বক, টিকালো নাসিকা, দীর্ঘায়ত মুখাবয়ব ইত্যাদি যদি আর্য বা তৎসম্ভূত উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, তাহলে বলতে হয় এই শারীরিক বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সব প্রান্তেই লক্ষ্য করা যায়, অথচ পৃথিবীর সব প্রান্তে তো ইওরোপ থেকে আর্য পরিযাণ (Aryan Migration) ঘটেনি। তাহলে?
তামিল ব্রাহ্মণ বা কেরলের নাম্বুদ্রিপাদদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য কি তথাকথিত আর্যসম, না কি দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য মানুষদের, এমনকি নিম্নবর্ণের মানুষদের সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন? কোন উত্তর মেলেনা ভারতে আর্যায়নের সমর্থকদের কাছ থেকে। তাহলে ব্রাহ্মণ বলে যদি কোন বিশেষ শারীরিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতই করা না যায়, তাহলে কি করে বলা যাবে যে তারা ‘আর্য জাতিসম্ভূত’?
আর্য জাতি তত্ত্ব যে একান্তভাবেই ইওরোপীয়ান ঔপনিবেশকারীদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র তা নিয়ে বর্তমানে কোন সন্দেহ নেই। সাম্প্রতিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় এই জাতি তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবেই বাতিলের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলতেই পারি, বর্তমান সময়ে আর্য জাতি তত্ত্ব (Aryan Race Theory) হল ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ (Living fossils)।
ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে জীববিদ্যা-নৃতাত্বিকগণ (Biological-Anthropologist) প্রশ্ন তুলেছেন, ‘How could one recognize an Aryan, living or dead, when the biological criteria for Aryanness are non-existent?’
এই প্রশ্ন সর্বসমক্ষে তুলে ধরার মালিকানা এখন আপনার হাতে, আপনি তা তুলে ধরবেন কিনা, সেটাই মহার্ঘ জিজ্ঞাসা।
।। সমাপ্ত ।।
ঋণ স্বীকার:-
1. Chakrabarti, Dilip K., 'India An Archeological History, Palaeolithic Beginnings to Early Historic Foundations', Oxford University Press, 2001.
2. Hemphill, B.E., Lukacs, J.R. and Kennedy, K.A.R., 'Biological Adaptations and Affinities of the Bronze Age Harappans', In 'Harappa Excavations 1986-1990: A Multidisciplinary Approach to Third Millenium Urbanism', R. Meadow (ed.), Madison, Prehistory Press, 1991.
3. Leach, E, 'Aryan Invasions Over Four Millenia', in 'Culture Through Time, Anthropological Approaches', E. Ohnuki-Tierney (ed.), Stanford University Press, 1990.
4. Mushrif-Tripathi, Veena, 'Human Skeletal Studies in India: A Review', in 'Archaeological Human Remains: Global Perspectives', Barra O'Donnabhain (ed.), Springer, 2014.
5. Shaffer, Jim G. and Lichtenstein, Diane A., 'South Asian Archaeology and the Myth of Indo-Aryan Invasion', in 'The Indo-Aryan Controversy, Evidence and Inference in Indian History', Edwin F. Bryant and Laurie, L. Patton (eds.), Routledge, 2005.
Comments
Post a Comment