দীপাবলি, কালী ও চর্যাপদের দেবী
।। কালী, চর্যাপদের দেবী ও
বাংলায় শক্তি সাধনা
।।
৫১ শক্তিপীঠের এক তৃতীয়াংশ দুই বাংলার মাটিতে ছড়ানো ।
দক্ষ কন্যা সতীর দেহাংশ সত্যিই এসব ক্ষেত্রে পড়েছিল কিনা সে বিতর্কে না গিয়েও একথা বলা যেতে পারে যে দীর্ঘসময় ধরে বাংলার মাটি শক্তি-সাধকদের সাধন -ক্ষেত্র।
কবে থেকে শক্তি সাধনার রূপক হিসাবে মাতৃপূজার প্রচলন ভারত তথা বাংলায়,
তা নির্ণয় করাও প্রায় অসম্ভব। 'মার্কন্ডেয় পুরাণ' (যার সাথে বাংলার মাটির নাম জড়িয়ে আছে ) - এর
81-93 অধ্যায়ের ' শ্রী চন্ডী ' অংশটি হল দেবী আরাধনার প্রাচীনতম রচনা । আবার মার্কন্ডেয় পুরাণের সাথে ব্যাসদেবের নাম জড়িয়ে থাকায় এর রচনা কাল মহাভারত যুগ হতে পারে ।
বেদ না তন্ত্র, কে বেশি পুরাতন সে বিষয়ে বিতর্ক আছে।
তবে ঋগ্বেদ ( 10/71/9) এবং অথর্ববেদ ( 10/7/42) -এ তন্ত্র জাতীয় শব্দ আছে । সংস্কৃত literature এর শ্রুতি,
স্মৃতি, দর্শন ইত্যাদি 6 টি ভাগের একটি হল 'আগম'।
আগম-এর তিনটি ভাগ ।
বৈষ্ণব, শৈব ও
শাক্ত । এই শাক্ত আগমের অপর নাম তন্ত্র ।
এই বাংলায় শক্তি সাধনার ইতিবৃত্ত জানার আগে আমরা এটা জেনে রাখতে পারি যে বর্তমানে যে কালী মূর্তি প্রচলিত আছে তার রূপকার ও পূজা বিধি চালু করেন পঞ্চদশ শতাব্দীর নবদ্বীপের সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ । তিনি 'তন্ত্রসার'
নামক গ্রন্থের রচয়িতা ।
সাংখ্য দর্শনে
পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্ব আছে । তন্ত্রে আছে শিব-শক্তি । এই তত্ত্বটি একটু বুঝে নেব আগে ।
পদার্থ বিজ্ঞান
(Physics) এ দুটো বিষয় থাকে । পদার্থ ও শক্তি
( যথাক্রমে matter and Energy )।
তন্ত্রে এ দুটিই
হল শিব ও
শক্তি । বস্তু ও চেতন । শিব, শব অবস্থায় হলেন নিশ্চল প্রাণহীন পদার্থ ।
কালী হলেন শক্তি । তিনি যখন শিবের সাথে যুক্ত হন শিব তখন চেতনা প্রাপ্ত হন। তিনি তখন গতিশীল হন, কর্ম ক্ষমতা প্রাপ্ত হন । বিজ্ঞানে বলা হয়
Energy কোনও পদার্থ কে
আশ্রয় না করে কখনও নিজ সত্তা প্রকাশ করতে পারে না । তেমনই পদার্থও শক্তি ছাড়া নিজের সত্তা প্রয়োগ করতে পারে না । শিব এবং শক্তিও তাই । অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কিত ।
ন্যূনতম 2000 BC থেকে বঙ্গ ভূমিতে জনবসতির নিদর্শন রয়েছে ।
প্রত্নবিদ দিলীপ কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন, বীরভূম থেকে মেদিনীপুরের দক্ষিণ-পশ্চিম,
বাঁকুড়া -বর্ধমান থেকে পুরুলিয়া
- এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রস্তর যুগের এবং বীরভূম,বর্ধমান,
বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরে তাম্র -প্রস্তর যুগের প্রচুর প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে ।
কিন্তু কৃষি, পশুপালন,
ধাতুর ব্যবহার জাতীয় প্রত্ন উপাদানের বাইরে ধর্ম-সাংস্কৃতিক দিকটি নিয়ে যথেষ্ট তথ্য আমরা এখনও পাইনি ।
যেহেতু গুপ্ত যুগের আগে বৈদিক সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটেনি তাই স্থানীয় মানুষের ধর্ম ভাবনা প্রাকৃতিক শক্তিমূলক ছিল ধরা যেতে পারে । বাংলা জুড়ে শক্তি পীঠগুলির অবস্থান এবং বশিষ্ঠ
-অষ্টাবক্র মুনিদের নাম কিছু পীঠের সাথে জড়িয়ে থাকায় এগুলি যে বহু প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে তা অনুমান করা সম্ভব ।
আদি শূর এবং সেন রাজবংশ দ্বারা বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ এনে বৈদিক হিন্দু ধর্মের পূনঃ প্রতিষ্ঠার পূর্বের বাংলার ইতিহাস বলতে আমাদের কাছে উপাদান হল পাল রাজবংশ এবং চর্যাপদ । এ
দুটিকে আশ্রয় করে কিছু আলোচনা হতে পারে ।
পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন এবং সেসময় (750 -1200AD) বাংলায় প্রধানতম ধর্ম বৌদ্ধ ।
অজস্র বৌদ্ধ বিহার
এবং নালন্দা-বিক্রমশীলা-ওদন্তপুরী ( পালেদের রাজ্যসীমা বিহার তো বটেই কখনও বেনারস পর্যন্ত ) র খ্যাতি তখন আন্তর্জাতিক ।
হিউয়েং সাং তমলুকে অনেক বৌদ্ধ বিহার দেখেছিলেন ।
কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম মানে কেবল চীবর পরিহিত একদল অহিংসা ইত্যাদি অষ্টাঙ্গ মেনে চলা ভিক্ষুক নন । এই ধর্মেও নানা বিবর্তন ও গোপন সাধন পদ্ধতি আছে ।
383 BC তে বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ মহাসম্মেলনে বৌদ্ধরা স্থবিরবাদ ও
আচার্যবাদ এই দুভাগে বিভক্ত হয়ে পরে । কনিষ্কের সময় চতুর্থ সম্মেলনে হীনযান ও
মহাযান, দুভাগে বিভক্ত হয়। মাঝে অশোকের আমলে তৃতীয় সম্মেলন হয় এবং ক্রমশই স্থবিরবাদ ভারতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে । অশোকের উদ্যোগে শ্রীলঙ্কা ও
ব্রহ্ম দেশে প্রচার হয়েছিল বলে স্থবির বা থেরবাদ ওদেশে টিকে থাকে ।
কিন্তু কনিষ্কের পরে মহাযানীরা দেহকেন্দ্রিক সাধনার দিকে ঝুঁকে যায়, তন্ত্র এসে পরে বৌদ্ধ ধর্মে। 'ব্জ্রযান' মূলত
বৌদ্ধ তন্ত্র এবং এরই পরবর্তী দশা হল 'সহজযান', যা বাংলায় প্রচলিত ছিল পাল রাজবংশের সমসাময়িক কালে। এই 'সহজযান'-এর
উত্তরসূরী রুপে আমরা বাউল, ফকির
সম্প্রদায়দের দেখে থাকি, এনারা
সহজিয়া-পন্থী। মহাযানীরা যখন তন্ত্রকে গ্রহণ করলেন, তখন পুরুষ বা শিব হলেন 'বজ্র' এবং শক্তি হলেন 'পদ্ম'। বজ্র
অর্থাত্ শিব সাধনার দ্বারা শক্তিকে জাগ্রত করবেন এই সাধনায়।
চর্যাপদের লুঁইপাদ, ভুসুকপাদ, কাহ্নপাদ ইত্যাদি
সাধকেরা চর্যার গীতিতে দেহকেন্দ্রিক শক্তি জাগরণের কথাই বলে গেছেন তাদের
চর্যাগানে। চর্যার রচনাকাল ঐতিহাসিকেরা মনে করেন নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। সেন
রাজাদের আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং পরবর্তী মুসলিম যুগে এই সহজযানী সম্পদায়ের পথিকেরা
হয় নেপাল-তিব্বতে চলে যান, অথবা বাংলায়
সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। বজ্রযান থেকে সহজযানের যাত্রাপথে নাথ সম্প্রদায়ের ( গোরখনাথ, মত্সেন্দ্রনাথ প্রমূখ) প্রভাবও রয়েছে।
১৩০০ নাগাদ বাংলায় আমরা দেখতে পাচ্ছি ৫ টি ধর্মমত প্রচলিত -
১। দেশীয় গ্রাম্যপূজা
২। বৌদ্ধ সহজযান
৩। নাথপন্থী যোগীমত
৪। ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং
৫। হিন্দু তন্ত্র
শিব-শক্তি সাধনাটি
বাহ্যিক নারী-পুরুষ (ভৈরব-ভৈরবী) দেহগত আচরণকেন্দ্রিক হয়ে ওঠায় সমাজে তন্ত্রের ব্যভিচার
নিয়ে বিরূপ ধারনার জন্ম নেয়। ঠিক এই সময়েই নবদ্বীপে দুজন মহান মানুষের আবির্ভাব
হয়। একজন শ্রীচৈতন্য, যিনি নাম সংকীর্তনমূলক ধর্ম প্রচার করেন ( যদিও পুরীতে রায়
রামানন্দ- স্বরূপ দামোদর-মাধবী -দের নিয়ে তন্ত্র অভ্যাস করতেন, এমন একটি ক্ষীণ প্রচারও আছে। বাংলায় নিত্যানন্দ নামসংকীর্তনের
প্রচার করলেও গৌরীয় বৈষ্ণবমতে বোষ্টম - বোষ্টমী্মূলক যুগল সাধনার রীতি আছে)। দ্বিতীয়জন
আগমবাগীশ। তিনি তন্ত্রকে অনাচার থেকে বার করে পূনরায় প্রকৃত পথে ফিরিয়ে আনতে
উদ্যোগী হলেন।
তন্ত্র, তা হিন্দু বা বৌদ্ধতন্ত্র যাই হোক না কেন, মূলকথা হল মানুষ আসলে শব। শক্তি হল তার চেতন। এই চেতন শক্তি
তাকে চালনা করে। কুলকুন্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করে সাধক শরীরের বিভিন্ন চক্র (
শক্তি কেন্দ্র; পিনিয়াল, পিটুইটারী ইত্যাদি Gland এর নিকটবর্তী অঞ্চল) অতিক্রম করে মস্তকে সহস্রারে এসে মিলিত হয়। সাধকের এই
শক্তির সাথে মিলনই হল তন্ত্রের ভাষায় 'মৈথুন', যাকে স্থুল যৌনতার
সাথে আমরা গুলিয়ে ফেলেছি।
চর্যাপদে আমরা
চন্ডালী, ডোম্বী, শবরী, যোগিনী ইত্যাদি নাম দেখতে পাই -
' জোইনি তঁই বিনু খনহি ন জিবমি'
' উচা উচা পাবত তহি বসই সবরী বালী'
' নগর বাহিরি ডোম্বী তোহরী কুরিআ' ইত্যাদি
এনারা সমাজের
অন্ত্যজ শ্রেণীর মহিলা এবং চর্যাপদের মাধ্যমে এনাদের জীবনচরিত বর্ননা করা হয়েছে
বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে চর্যাগীতিকাররা এনাদেরকে রূপক হিসাবে প্রয়োগ করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় যখন নেপাল থেকে আবিস্কৃত ৫০ টি চর্যাগানসহ
'হাজার বছরের পুরাণ
বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ প্রকাশ করেন তখন ৫০ টি চর্যা গানের সাথে মুনিদত্ত প্রণীত সংস্কৃত টীকা যুক্ত
ছিল। ঐতিহাসিকেরা মুনিদত্তকে পঞ্চদশ শতকের মানুষ বলে চিহ্নিত করেছেন এবং তিনিও
সহজপন্থী সাধক ছিলেন বলে তার প্রদত্ত যৌগিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে আমাদের।
কাহ্নপাদ ১০ ম চর্যাগানে বলেছেন,
' তু লো ডোম্বী হাউ কপালী '
মুনিদত্ত এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ' হউ কপালিকঃ চর্যাধরশ্চ'। আমি কাপালিক ও
চর্যাধর। অর্থাত্ কাহ্নপাদ যুগপত কাপালিক এবং চর্যার সাধক।
১৯ তম পদের
ব্যাখ্যায় মুনিদত্ত চর্যাকে বলছেন 'যোগিনীপ্রসাদজাত'। হেবজ্রতন্ত্র-তে সাধনার ৫টি ভাগ রয়েছে। ক্রিয়া, চর্যা, যোগ, যোগোত্তর এবং
যোগনিরুত্তর। চর্যা হল সাধনের দ্বিতীয় স্তর।
তন্ত্রের সাথে
চর্যার সাধনার অনেক মিল রয়েছে। তন্ত্রে বা যোগে উল্লিখিত আমাদের শরীরের ষটচক্র ( মূলাধার, স্বাধীষ্ঠান, মনিপুর, অনাহত, আজ্ঞা ও সহস্রার) এর মতন বৌদ্ধতন্ত্রে তথা ব্জ্রযান ও সহজযান মতেও শরীরের চার স্থানে চার চক্র বা Power centre ( নাভি, হৃদয়, কন্ঠ ও ব্রহ্মতালু তে যথাক্রমে নির্মাণচক্র, ধর্মচক্র, সম্ভোগচক্র এবং
মহাসুখচক্র )। তন্ত্রের শিব-শক্তির মতন এখানে ব্জ্র ও পদ্ম। চক্রে চক্রে সাধনার
স্তর অতিক্রম করে সাধক আত্মশক্তির সাথে মিলিত হন। সেই মিলন হল বজ্র-পদ্ম বা
শিব-শক্তির মিলন।
ডোম্বী, চন্ডালী, নটী, রজকী ও ব্রাহ্মণী
হলেন সহজযানে ৫ শক্তিকুল। মনে করা হয় যে প্রতিটি জীবের একটি সহজ স্বরূপ আছে। পঞ্চ
শক্তিকে চিনে নিয়ে এই সহজস্বরূপকে উপলব্ধি করা যায়।
যোগ বা তন্ত্রে
মেরুদন্ডের ডান ও বাম দিক দিয়ে বয়ে চলা দুই নাড়ীর ( ডান ও বাম নাক দিয়ে বয়ে চলা
নিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত; anatomically dead body তে পাওয়া যায় না। চেতন শক্তির প্রবাহ, যা শবদেহে থাকে না) নাম ঈড়া-পিঙ্গলা। বজ্রযান মতে তা হল ললনা ও রসনা। চর্যাতে
ললনার নাম 'আলি' এবং রসনার নাম 'কালি'।
' আলি এ কালি এ বাট রুন্ধেলা
তা দেখি কাহ্ন বিমন ভইলা ' - কাহ্নপাদ । ৭ ম গীতি।
আলি-কালি-এর
দ্বার রূদ্ধ করে কাহ্নপাদ মনশুন্য হলেন।
আলি ও কালির পথ রুদ্ধ হলে সুষুম্না তথা অবধূতির পথে চেতন শক্তি প্রবাহিত হলে যে সুপ্ত শক্তি জাগ্রত
হয় চর্যাকারের ভাষায় তার নাম 'চন্ডালী'। জাগ্রত চন্ডালীর উপলব্ধিজনিত মানসিক অবস্থা হল সহজযানীদের কাছে 'বোধিচিত্ত"। যোগসাধনার দ্বারা জাগ্রতা দেবী 'চন্ডালী' হৃদয়দেশে 'ধর্মচক্র' কে দগ্ধ করে 'সম্ভোগচক্রে' প্রবেশ করে। উর্ধপথে 'চন্ডালী'র অপর নাম 'ডোম্বী'। সহজচক্রে প্রবেশ করার পরে নাম 'সহজসুন্দরী'। প্রতি চক্রে জাগ্রতা শক্তিকে দেবীরুপে কল্পনা করা হয়েছে।
আমরা হিন্দু
তন্ত্রে যে কালী, চন্ডী, ত্রিপুরসুন্দরী ইত্যাদি শক্তিরূপিনী দেবীর আরাধনা দেখে থাকি
চর্যার সাধকদের ভাষায় তারাই হলেন কালি, চন্ডালী, সহজসুন্দরী। হিন্দু
তন্ত্রে দশমহাবিদ্যার প্রধান দেবী হলেন কালী। এছাড়াও তারা, ধূমাবতী, ভৈরবী ইত্যাদি দেবীও আছেন। এই দশ মহাদেবী অবস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হলেও আসলে
সকলেই একই মূল শক্তি; একই দেবী।
এই যে আমাদের ভেতরের চেতনশক্তি, যাকে আমরা বাহ্যিক দেবী্রূপে কল্পনা করে পূজা করি, সে সম্পর্কে চর্যাগীতিকার সরহপাদ বলছেন,
‘ ঘরে অচ্ছই বাহিরে পুচ্ছই
পই দেকখই পড়িবেশী পুচ্ছই ।।
- অর্থাত্ যা আমার ঘরে আছে, তাকেই বাইরে খুজছি। পতিকে যেমন
স্ত্রী প্রতিবেশীর ঘরে খুজছে।
ব্যক্তিগত
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কাশ্মীরের লাদাখ
অঞ্চলে লে শহরের নিকটে এক বৌদ্ধগুম্ফাতে সর্বোচ্চতলাতে (সর্বসাধারনের জন্য অবারিত
নয়) রয়েছে দেবী 'তারা'র মূর্তি। বৌদ্ধ সাধক (সেখানে লামা)-এরা ঐ তারা মূর্তিকে
পূজা ও আরাধনা করেন। ঐ গুম্ফার নিচের তলায় যেখানে সাধারনের প্রবেশ অবাধ সেখানে
আমাদের পরিচিত বুদ্ধমূর্তি ও প্রার্থনা ঘর।
বাংলায় বৌদ্ধ
তন্ত্রের সাথে হিন্দু কালী শক্তিসাধনার অনেক নিদর্শন বাংলায় ছড়িয়ে আছে। তারাপীঠ এর
দ্বিতীয় সত্তা রূপে নিকটবর্তী (১৯ কিমিদূরে) মলুটিতে মা মৌলাক্ষী দেবী মন্দির। সাধক
বামাখ্যাপা প্রথমজীবনে এখানেই সাধনা করেছিলেন। কথিত আছে নাটোরের রাজা রাখড়চন্দ্র এবং তার গুরু কাশীর সুমেরু মঠের দন্ডিস্বামী
জঙ্গলে এই দেবীমূর্তিটিকে প্রাপ্ত হন এবং সেই দন্ডীস্বামীজীর মতে এই দেবীমূর্তিটি
বৌদ্ধতান্ত্রিক দেবী এমনটাই প্রচলিত ধারনা ( বৌদ্ধ দেবীর মতন এর বর্ণ লাল ইত্যাদি
লক্ষণ দেখে দন্ডিস্বামী চিহ্নিত করেন )। বৌদ্ধ বজ্রযানের দেবীমূর্তি-ই সেখানে
হিন্দু কালী বা তারা মা রূপে পূজিত হচ্ছেন এখন।
মার্কন্ডেয় পুরাণের শ্রী চন্ডী অংশের কাহিনী হল রাজ্যচ্যুত দুই রাজা সুরথ ও
বৈশ্য এবং মেধষ মুনির মধ্যে কথোপকথনের কাহিনী। বহিঃশত্রু এবং আমাত্য বিদ্রোহে দুই রাজ্যহারা রাজা পালিয়ে আসেন এক জঙ্গলে এবং
হঠাত্ই তাদের সাক্ষাত্ হয়ে যায়। তাদের সাথে আবার দেখা হয়ে যায় মেধস মুনির। তারা
যখন জিজ্ঞাসা করেন মুনিকে যে সব হারিয়েও তারা কেন রাজ্য,পরিবার ইত্যাদি ভুলতে পারছেন না তখন মেধস মুনি জানান যে
জগত্ মায়া ও মোহ দ্বারা আবৃত এবং তা মহামায়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই মহামায়া কে, এই প্রশ্ন করলে মেধস মুনি যা বলেন তা-ই হল 'শ্রী চন্ডী'।
স্বামী বেদানন্দ(যার পূর্বনাম শীতলচন্দ্র), যিনি বরিশালে জন্ম গ্রহণ করেন, তিনি ১২৬৬ বঙ্গাব্দে আবিস্কার করেছিলেন চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাশের
জঙ্গল হল সেই স্থান যেখানে কর্নফুলি নদীর তীরে দুই রাজার দেখা হয়েছিল এবং এর পাশেই
পুষ্পভদ্রা নদী পার হয়ে তারা মেধস মুনির আশ্রমে আসেন।
সম্ভবত গৌরীতন্ত্রের কামাখ্যাপটলের নিন্মলিখিত অংশটি বেদানন্দের হাতে আসে।
' কর্নফুলি মহানদী...মার্কন্ডেয় মুনেঃ স্থানং
মেধসোমুনেরাস্রমঃ।
ত্ত্রচ দক্ষিণাকালী বাণলিঙ্গং শিবং স্বয়ং '
চট্টগ্রামে ৫১ পীঠের এক
পীঠস্থান। বেদানন্দের মতে এই সেই স্থান যেখানে মেধস মুনি 'শ্রী চন্ডী'-তত্ত্ব দুই রাজ্যচ্যুত রাজাকে জানিয়েছিলেন, যার থেকে মার্কন্ডেয় পুরাণে সেই অংশ রচিত হয়। আমরা অনুধাবন করতে পারি যে কি প্রাচীন সময় থেকে এই বাংলার মাটিতে শক্তি সাধনার
ধারা প্রচলিত আছে। শোনা যায় বর্তমানের কলকাতার পার্ক ষ্ট্রীট অঞ্চল, যার পুরনো নাম ছিল চৌরঙ্গী, তা চৌরঙ্গীনাথ নামক এক মহা সাধকের নাম থেকে সৃষ্ট। কালীঘাট যখন ঘোর জঙ্গলপূর্ণ
( ইংরেজদের কলকাতা স্থাপনের আগে পর্যন্ত) তখন সেই সাধক এখানে বাস করতেন। সেই রকম বশিষ্ট, অষ্টাবক্র ইতাদি নানা পৌরানিক মুনির নাম তারাপীঠ, বক্রেশ্বরের মত শক্তিপীঠগুলির সাথে লোককথায় যুক্ত হয়ে আছে।
দেবীর ৫১ পীঠের
১৫/১৬ টির অবস্থান দুই বাংলাতে। বঙ্গভূমিতে শক্তি আরাধণার ইতিহাস অতি প্রাচীন। হিন্দু হোক বা বৌদ্ধ, শক্তি আরাধনাকে এড়িয়ে বাংলার জনমানস থাকতে পারেনি। কয়েকশ বছর আগেও কৌল
ব্রাহ্মণদের রমরমা ছিল। এরাও শক্তিসাধক। খুব নিকট অতীতে রামকৃষ্ণ, বামাখ্যাপা, রামপ্রসাদের মতো সাধকদের কথা আমরা জানি।
মাতৃসাধনা তথা
শক্তি সাধনার পীঠস্থান এই বঙ্গভূমি তাই দীপাবলীতে শক্তি আরাধনার দিন, যদিও অন্যান্য প্রদেশে এই দিনে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা হয়ে
থাকে। জৈনদের কাছে এই দিন
পালিত হয় মহাবীরের বন্ধন-মুক্তির দিবস রূপে। নেপালের বজ্রযানপন্থীরা ( Newar Buddhist) এই দিনে দীপাবলী তথা লক্ষ্মীর
আরাধনা করেন।
চেতন তথা
চৈতন্যশক্তির প্রতীক দেবী মায়ের উদ্দেশ্য আমরা বলতেই পারি
' ওম শ্রী মহা কালীকায়ৈ
নমঃ'
আমাদের প্রত্যেকের
চেতনা জাগ্রত হোক ।।
সূত্র –
১। চর্যাগীতিকোষ – সৌমেন্দ্র
নাথ সরকার
২। An Introduction to Tantric Buddhism – শশীভূষণ দাশগুপ্ত
৩। স্বামী বেদানন্দের অদ্ভুত আবিস্কার – স্বামী অলোকেশানন্দ
Comments
Post a Comment