বৈদিক সভ্যতা ও Indian Archaeology Part 3

।। বৈদিক সভ্যতা ও Indian Archaeology ।।
Part  3
।।  ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা এবং অশ্ব ও রথ  ।।
  ইরাকের হিটাইট, মিতান্নি ও ক্যাসাইট দের  (1400 BC) দের লেখ্য উপাদানের সাথে বৈদিক শব্দাবলীর কিছু মিল পেয়ে  ( ইন্দ্র, সূর্য, অশ্ব, সপ্ত ) ভাষাতাত্ত্বিকেরা পরম উৎসাহে  ভারতে আর্য আগমনের এক রূপরেখা তৈরি করেন ।
   মজা হল যে শুধু কয়েকটি শব্দ দিয়ে কি ওদের আর্য গোষ্ঠী ভুক্ত করা যাবে  ?  সে তো দ্রাবিড় ভাষাগুলির মধ্যে ও অনেক সংস্কৃত শব্দ  এবং  সংস্কৃত ভাষাতে অস্ট্রিক শব্দাবলী পাওয়া যায় ।  তাহলে  এরা কি একই ভাষাগোষ্ঠী ।  ভাষা মানে তো তার বাক্যশৈলী, তার ব্যাকরণ অনেককিছু।
   আসলে তুলনামূলক ভাষা তত্ত্ব  এক অদ্ভুত বিষয় । এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত ।  এ নিয়ে আর্য আগমনের প্রমাণ বের করা মুশকিল । যদিও এই চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে  এবং  RS Sharma,  I Habib, R Thapar এর মতন ঐতিহাসিকেরা  এই ভাষাতাত্ত্বিক ধারণা দিয়ে আর্য আগমনের পক্ষে মত দিচ্ছেন ।
   Cambridge এর প্রত্নবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ  J Shaffer এর বিরোধিতা করে বলেছেন যে ভাষাতাত্ত্বিক তত্ত্বকে প্রত্ন ও নৃতাত্ত্বিক তথ্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে । এসব ভাষাতাত্ত্বিক অত্যাচার বন্ধ হোক । ( it is time to end the linguistic tyranny - 1984)।
  কিন্তু কে শুনছে ।  বৈদিক উপাদান কে যে যার মতো ব্যাখ্যা করছেন । একটি উদাহরণ দিই ।
  M witzel এবং RS Sharma তৈত্তিরীয় সংহিতা -র 'বৌধায়ণ শৌতসূত্র' থেকে একটি কাহিনী নিলেন,  যেখানে উর্বশী তার দুই পুত্র  আয়ু ও অমাবসুকে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে যেতে বলেছেন ।  শর্মা বললেন এই আয়ুর পুত্র রা হলেন 'আয়ভ গোষ্ঠী ', এবং এরাই কুরু-পাঞ্চাল স্থাপন করেন । অর্থাৎ আর্যদের পূর্বদিকে  অর্থাৎ ভারতে আগমনের বৈদিক তথ্য এটি ।
   আমরা কি প্রশ্ন করব না  ? জানতে চাইব না কি যে
- আয়ু পূর্ব দিকে এলো বুঝলাম । তা কোথা থেকে এলো  ?  সিন্ধু - পাঞ্জাব থেকে পূর্ব দিকে এলেও তো কুরু -পাঞ্চাল হয় !
- তার চেয়েও বড় কথা,  আয়ুর ভাই অমাবসু যে পশ্চিম দিকে গেল সেটার কি হল  ?
- এমনটা হওয়া কি স্বাভাবিক নয় যে সিন্ধু -পাঞ্জাব থেকে অমাবসুকে গান্ধার  অঞ্চলে এলেন ।
- দুই বীর ভ্রাতা  সিন্ধু -পাঞ্জাব থেকে  দুদিকে গিয়ে এক সাম্রাজ্য তথা  সংস্কৃতির বিস্তার করলেন । একটি  আফগানিস্তানে  ও একটি উত্তর প্রদেশে । এমন ধারণাই তো ঐ কাহিনী থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক ।
- তার বদলে কি কষ্ট কল্পনা  !! Tyranny  ই বটে  !!
  আর একজন British Anthropologist ( দেশ শাসনের জন্য তদানীন্তন ব্রিটিশ রা অন্য কথা বললেও  এখনকার ব্রিটিশ পন্ডিতেরা কিন্তু নিরপেক্ষ কথা বলছেন ) এবং   former President of Royal Anthropological Institute, বললেন যে   এসব ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনেক আগেই বাতিল হওয়া উচিত ছিল । কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থ ও পদ এর বাধাস্বরূপ  ( Indo European scholars should have scrapped all their historical reconstruction. ... but this is not happened.  Vested interest and academic posts are involved - Edmund Leach 1990)
 হ্যা  !  একজন  Knighthood প্রাপ্ত ব্রিটিশ  নৃতাত্ত্বিক ' vested interest ' কথাটি ব্যবহার করেছেন ।
  মজা হল যে -
 বৈদিক text গুলো নিয়ে যা খুশি বলা যায় । কারণ -
1। অশোকের শিলালিপির মতন বৈদিক পাথুরে প্রমাণ নেই ।
2। বেদ শ্রুতি অবস্থায় দীর্ঘদিন চর্চা হয়েছে । লেখা হয়েছিল অনেক পরে ।
3। লেখা হত ভূর্জ পত্র,  তালপাতা ইত্যাদি তে । নষ্ট হয়ে যেত বলে কিছু সময় পর পর  copy করা হত ।
4। ফলে আসলে বৈদিক text যা পাওয়া গেছে ঐতিহাসিক ভাবে তা মাত্র দু একশ বছরের পুরনো ।
5। লিপি নিয়েও সমস্যা। আদিতে কোন লিপিতে লেখা হয়েছিল কেউ জানে না । দেবনাগরী মাত্র কয়েক শো বছরের পুরাতন । খৃষ্ট জন্মের অনেক পরে ।
6। ব্রাহ্মী  500 BC তে পাওয়া গেছে  এবং  সিন্ধু লিপি কে ব্রাহ্মীর পূর্ব সুরী হিসেবে মেনে নিতে সময় লাগবে ।
   ফলে বৈদিক text দিয়ে  আর্য আগমনের প্রমাণ করা যাচ্ছে না  বোঝা গেল ।  কারণ কবে সেসব রচনা হয়েছে তা-ই নির্ধারিত করা যাচ্ছে না । আর্য বৈদিক কাহিনী গুলিতে এদেশে আগমনের সত্যি ই কিছু কথা নেই । বরং চন্দ্র বংশের যযাতির  দুই  ছেলে  অনু ও দ্র্যুহু র মাধ্যমে বৈদিক সংস্কৃতি পশ্চিমে  (  অন্য ভাই পুরু  ও যদু দের বংশের কাহিনী মহাভারত ) গেছিল,  এমনটাই বোধ হয় ।
   ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা ছেড়ে তাই আমরা প্রত্ন নিদর্শন নিয়ে মাথা ঘামাবো । আমরা বৈদিক সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে দেখে নেব , সেগুলো  1400 BC পরে ভারতে এলো নাকি  ? যদি তাই হয় তাহলে আমরা মানতে রাজি যে  এরপরেই  আর্যরা ভারতে এসেছিল এবং বৈদিক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল ।
Point গুলো হল -
1।  অশ্ব বা ঘোড়া
2।  রথ ও spoked wheel
3 । লোহার ব্যবহার
4।  যজ্ঞ  ও  অগ্নিশিখ
5।  মৃত  সৎকার
6।  কৃষি।      ইত্যাদি
   আগেও বলেছি  reference আমরা  RS  Sharma,  I Habib মহাশয়দের বই থেকেই নেব । কিন্তু deduction আমাদের হবে ।
অশ্ব :-
   অশ্ব কে আর্যদের সাথে সমার্থক মনে করা হয় । তাহলে  1400 BC র আগে ভারতে ঘোড়া নেই ? একটু দেখে নিই প্রত্ন  উপাদাগুলোকে  --
- Neolithic প্রস্তর যুগ থেকেই ভারতে অশ্বের অস্তিত্ত্ব কথা বলেছেন G R Sharma et al ' Beginning in agriculture ' বইতে ।  এটি Equus namadicus প্রজাতির ঘোড়া ।  ইউরোপের Equus ferus caballus ঘোড়া  নয় ।  তবে  ঘোড়া তো বটেই । এবং  বহু নিদর্শন মিলেছে সে সময়কার।
- রাজস্থানে  বাগোর  ( সেই সোনালী পঞ্চভূজের একটি কেন্দ্র !) এ 4500 BC র গৃহপালিত অশ্ব। ( EIA = Encyclopedia of Indian Archaeology by A Ghosh,  1989)
- কর্ণাটকে কোদেকাল,  হাল্লুর  এ প্রস্তর যুগে  (EIA )
- Surkotda  2100- 1700 BC
- Rana Ghundai  3000 BC  ( দিলীপ কু চক্রবর্তী  এটি অশ্ব বলেই নিশ্চিত করেছেন )।
- গুজরাত এ  মালাবান,  লোথাল ও হরপ্পা  তে  হয়  অস্থি না হয়  terracotta
- সুরাটে মালায়াল
- পিরাক  2000 BC
  ইত্যাদি ।
   তাহলে  1400 BC র আগে  এই উপমহাদেশে অশ্বের ব্যবহারের প্রমাণ তো আছেই । তাহলে  ?
   এবার নতুন কথা এলো  ।
   ঋগ্বেদ এ 'গো' শব্দটির ব্যবহার  176 বার,  কিন্তু ' অশ্ব'  শব্দটি  215 বার ।  অশ্ব তাই  আর্যদের প্রতীক ।  Ukraine / Uzbekistan এর মতন  অশ্ব বহুল অঞ্চল তাই  আর্যদের আদি ভূমি ।  ভারতের  এতো  অল্প ঘোড়ার দেশ  আর্যদের আদি নিবাস হতেই পারে না ।
    আমরা একটু দেখে নেব ঋগ্বেদ  এ অশ্বের কথা কিভাবে আছে ।
1।  অবশ্যই বেদ এ অশ্বের জয় জয়কার ।  তবে  অধিকাংশই ' অশ্ব দাও!  হে দেব অশ্ব নিয়ে এসো ' জাতীয়  প্রার্থনা ।
2।  অশ্বের চাহিদা  প্রচুর । কিন্ত supply কম ।
3।  নৃপতিরা  হাজার হাজার গো দান  করলেও  অশ্বের দান খুব কম ।
4। 4/15  সূক্তে  পাচ্ছি,  সোমক রাজা  ঋষি  বামদেব কে  দুটি  অশ্ব দান করেছেন । তাতেই  রাজার নামে প্রশস্তি ।
5। অশ্ব নৃপতিদের সাথে  সম্পর্কিত,  সাধারণ মানুষের কাছে দুর্লভ ।
6।  Ukraine / Kazakhstan এ এমনটা নয় । সেখানে  অশ্ব দিয়ে  কৃষি  ও  ভারবহন করাচ্ছে সাধারণ মানুষ ।
    ভারতে  অশ্বের ব্যবহার সে সময়ের মানুষ জানেন । অশ্বের supply কম । তাই  দাও দাও বলে  প্রার্থনা ।
     আচ্ছা ,   এ যুক্তি  যদি  পছন্দ না ও করেন তাহলে  একথা  তো  মানবেন যে  1400  তে তথাকথিত আর্য আগমনের পরে  অশ্বের প্রচুর  প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া  উচিত । মুশকিল হল,  তাও তো বিশেষ আহামরি নয় ।
  নরহান , বালিয়া,  হস্তিনাপুরে  1000  BC র পরে  এবং  এরও  পরে  বৈশালী,  রাজগীর  ইত্যাদি কয়েকটি জায়গায় ।
  সংখ্যার বিচারে  1400 BC  র  আগের থেকে  বেশি নয়। শুধু  হরপ্পা  ক্ষেত্রগুলি থেকে  পূর্ব দিকে সরে এসেছে ।
   একথা তো আমরা জানিই  যে নানা কারণে  হরপ্পা  ক্ষেত্রগুলোর  থেকে  জনবসতি  পূব দিকে সরে এসেছে  1900 BC র পরে ।
     আমরা যে সোনালী  পঞ্চভূজের  কথা আলোচনা করছি তার  পশ্চিম প্রান্ত  ও দক্ষিণ সীমাতে ঘোড়া পাচ্ছি , পাচ্ছি  রাজস্থানেও । সবই  1400 BC র অনেক আগেই ।  হঠাৎ  করে  এদেশে  ঘোড়া আসেনি ।

রথ  ও চাকা  :-
 Romilla Thapar  ( Cultural Pasts,  2000, ) এ বলেছেন , চাকা  এবং  রথ  আর্যদের সাথে ভারতে  প্রবেশ করেছে  1500 BC নাগাদ ।
M Witzel  ( Early Indian History, 1995) এ বললেন,  রথ নিয়ে এসে আর্যরা স্থানীয়দের চমকিত করে দিয়েছিল  ( the first appearance of  ( the invading aryans) thundering chariots must  have striken the local population with a thunder).
  তাহলে  আমরা  এটাই ধরে নেব যে  1400 BC র আগে  এখানকার লোকজন  রথ  সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল । কিন্ত  প্রত্ন প্রমাণ কি বলে  ?
1।  দাইমাবাদ ( মহারাষ্ট্র )  এ  রথের terracotta পাওয়া গেছে ।  Auchin Brothers  এর ছবি ছেপেছেন ।
2। Rao দেখিয়েছেন  ( Puratatta  2005-6) লোথাল , ভিরানা  তে  চাকা পাওয়া গেছে ।
3। Danino দেখিয়েছেন,  রাখিগরহি  ও বানাওয়ালি  তে spoked wheel এর terracotta মিলেছে ।
4। সর্বোপরি  এই কদিন  আগেই  Sinauli  ( উত্তর প্রদেশ) তে  2000  BC  সময়ের  তিনটি  Bronze যুগের  রথ  পাওয়া গেছে ।
   উত্তর প্রদেশে  2000 BC  তে  রথ  পাওয়ার পরে  তথাকথিত  আর্যদের  রথ  নিয়ে  এদেশে  এসে  চমকে  দেওয়ার  তত্ত্ব  কি  আর  গ্রহণ করা  সম্ভব  ?
 3 টে part এও শেষ করতে পারলাম না । এসব কথা আসলে  30 টি পর্বেও শেষ করা মুশকিল । যাহোক  আর একটিতে শেষ করতেই হবে ! পূজার মুখে আর জ্বালাব না বেশ  ।
ক্রমশ :

Comments

Popular posts from this blog

কঠোপনিষদ ২০

উপনিষদ পর্ব 1

মহাভারত শ্লোক