বৈদিক সভ্যতা ও Archaeology. 4th Part

।। বৈদিক সভ্যতা ও Indian Archaeology ।।
পর্ব  4
।।  যজ্ঞ,  মৃত সৎকার,  লোহা  ইত্যাদি ।।
যজ্ঞ ও  অগ্নিবেদী : -
  বৈদিক সংস্কৃতির জোরালো নিদর্শন হল যজ্ঞ এবং যজ্ঞ করতে গেলে চাই অগ্নিবেদী।  আমরা দেখে নেব যে 1400 BC র আগে  এই উপমহাদেশে এর আগের সময়ে এর প্রত্ন প্রমাণ আছে কিনা  !
- Sankalia দেখিয়েছেন বেলুচিস্তানের  আমরি  তে
- Rao দেখিয়েছেন  লোথাল  এ
- BB Lal দেখিয়েছেন কালিবঙ্গান  এ
- লুধিয়ানা র দধোরি
  এগুলো সবকটাই  Late  Harappan period এর ।
 RS Sharma স্বীকার করেছেন যে  বেলুচিস্তানের কচি সমতলে  1800 BC সময়ের কয়েকটি  অগ্নিস্থল পাওয়া গেছে ।  এগুলোকে  যজ্ঞবেদী বলে Sharma মানতে দ্বিধাগ্রস্থ ।
- দিলীপ কুমার চক্রবর্তী  দেখিয়েছেন  'মালব সংস্কৃতি ' তে 2nd Millennium BC তে পাওয়া গেছে ।
   তাহলে  ঐ তথাকথিত আর্যদের আসার আগেই এসব রয়েছে ।
  আবার  উল্টোদিকে  বলতে চাই যে,  আর্যরা  আসার  (?) পরে  কি  প্রচুর নিদর্শন মিলেছে  ? তাও তো নয় ।
- অত্রঞ্জিখেরা  1200 BC
- মথুরা 300 BC
- কৌশাম্বী  200 BC
  খুব অল্প।  মথুরা,  কৌশাম্বী র কাল  আবার  বৌদ্ধ যুগের ।  তাহলে  ?
মৃত সৎকার  : -
   বৈদিক  তথা পরবর্তী হিন্দু  সংস্কৃতিতে  মৃত কে দাহ করাই  সৎকারের  একমাত্র পদ্ধতি মনে করা হয় । সম্পূর্ণ দাহ করে দগ্ধ নাভি বিসর্জন দিলে তার প্রত্ন প্রমাণ তো পাওয়া সম্ভব নয় ।
 তবে  RS Sharma  'শতপথ ব্রাহ্মণ '  এবং 'শ্রৌত সূত্র  ও গৃহ্যসূত্র' -এর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন বহু ক্ষেত্রে  সম্পূর্ণ দাহ না করে  অস্থি সংগ্রহ করা হত এবং অস্থিসহ সমাধি  দেওয়া হত ।
  আমরা প্রত্ন নিদর্শন গুলি দেখে নেব ।
- Vats  ( Excavation at Harappa,  1941) হরপ্পা তে দাহ পরবর্তী সমাধি পেয়েছেন ।
-  Marshall  (1931) বেলুচিস্তানের সমাধিগুলিতে মানবাস্থি পেয়েছিলেন ।
  ঋগ্বেদ  ( 10/16/4) এ  অন্তেষ্টিতে শবদেহের সাথে পশু দাহের  কথা বলা আছে ।
   অথর্ববেদে ও ( 12/2/48) এমন কথা আছে ।
Vats 175 টি ক্ষেত্রে  দাহ পরবর্তী নিদর্শনে পশুর হাড়গোড় পেয়েছিলেন ।
   তাহলে  খুব বেশি পার্থক্য কি পাওয়া গেল  ?
লোহা  :-
  Chalcolithic period হল  তামা -ব্রোঞ্জ এর যুগ । সিন্ধু সভ্যতার রমরমা  এই ধাতুর ব্যবহারের উপরেই দাড়িয়ে আছে ।  অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয়  লোহার ব্যবহার হল  আর্যদের USP  । এর মাধ্যমেই তারা  এই উপমহাদেশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন ।
  একটু দেখে নিই  I Habib এর তথ্য ( page 93-98) কি জানাচ্ছে । উত্তরপ্রদেশ,  বিহার,  যেখানে বৈদিক সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল ধরা হয়  সেখানকার লোহার নিদর্শন হল
- আত্রাঞ্জিখেরা  640  BC
- উচ্চ গাঙ্গেয়  অববাহিকা 800 BC
- নরহান  900 BC
- চিরান্দ  885 BC
-  এমনকি  বাংলার মহিষাদলে  820 BC
আমরা মনে রাখব যে তথাকথিত আর্যদের আগমনের তারিখ  1400 BC । কেউ বলতেই পারেন যে আর্যদের গুছিয়ে নিতে হয়তো  500 বছর লেগে গেছে ।
   কিন্তু  আরও গল্প আছে  !  তথাকথিত  আর্যদের ক্ষেত্র   নয়  এমন স্থানে যে  আগেই  লোহা পাওয়া গেল  !!  এও তো হাবিব সাহেবের বইতে পাচ্ছি ।
- মান্ডিগাক  - 2300 BC র (  প্রাথমিক  ' নরম লোহা ')
- সোয়াট  1200  BC
-  মুঘল গুন্ডাই  1100-800 BC
-  কর্নাটকের  হাল্লুর  1385 BC
- কর্নাটকের  কোমারানাহাল্লি 1440 BC
 প্রথম তিনটি সিন্ধু সভ্যতার অংশ।
   তাহলে  এই উপমহাদেশে লোহার ব্যবহার এর জন্য আগত আর্যদের যুক্ত করার কোনও কারণ নেই ।
   আসলে বাইরে থেকে কেউ বৈদিক কৃষ্টি নিয়ে আসে নি মোটেই । যে সোনালী পঞ্চভূজের কথা আলোচনা করছি আমরা  তার ঠিক ধার ধরে প্রসারিত হয়েছিল ভারতীয় সভ্যতা । পূর্বে  বাংলা,  পশ্চিমে আফগানিস্তান, দক্ষিণে কেরল - কর্নাটক,  উত্তরে কাশ্মীর  অবধি এই সভ্যতার বিস্তার হয়ে গেছে  1000 BC র মধ্যেই  ( যার শুরু 7000 BC নাগাদ )।
    তাহলে  এই  চার পর্ব ধরে  আমরা কিভাবে এই ইতিহাসকে  দেখলাম  একটু দেখে নিই বরং -
1।  সোনালী পঞ্চভূজ  যেটিকে বলছি  সেটি আসলে চতুর্ভুজ,  যার  মধ্যে  একটি কেন্দ্র  রাজস্থানের বাগোর । একে  মাঝে রেখেই  পশ্চিমে মেহেরগড়ে, উত্তরে হরিয়ানার ভিরানা,  পূবে Koldihwa - Jhusi এবং দক্ষিণে  মধ্যপ্রদেশ  এই চারটি কেন্দ্র কে যোগ করলে  আমরা  7000 BC পরবর্তীকালীন কৃষি,  পশুপালন সহ ধারাবাহিক যৌথ বসবাসের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি । ক্রমে ধাতুর ব্যবহার ও নানা পাত্রাদি Culture এর বিকাশ হচ্ছে ।
2। ক্রমশ এলাকার বিস্তার ঘটেছে । পশ্চিম দিকে নাগরিক কৃষ্টি,  দক্ষিণে লোহার আবিস্কার  এবং  পূর্বে গ্রামীণ গবাদি  কৃষ্টি র বিকাশ  লক্ষ্যনীয় ।
3। বৈদিক মানে আমরা মনে করি একদল লোক যারা মন্ত্র পাঠ করে যজ্ঞ করত । যজ্ঞ মানেই অগ্নিবেদী ও তার চারপাশে ঋত্বিক, হোতা এসব ব্রাহ্মণ  এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক  ক্ষত্রিয় যজমান ।  এরাই হল আর্য  !
4।  কিন্ত এটি সম্পূর্ণ চিত্র নয় । সমগ্র  আর্য সংস্কৃতির এক খন্ড অংশ।  আর্য কোনও  race তো মোটেই নয় । এটি  একটি সংস্কৃতি ।  পাঞ্জাবি দের মধ্যে Genetic মিল থাকলেও  শিখ , হিন্দু,  মুসলমান  পাঞ্জাবি  সংস্কৃতিতে আলাদা হবেন । আবার উল্টোদিকে  ভারতের  উত্তর,  পূর্ব বা  দক্ষিণের  মুসলমান  কৃষ্টি তে এক হলেও  genetically আলাদা হবেন ।  আর্য জাতি বা আর্য জিন বলে আসলে কিছু হয় না ।
5। 'ধম্মপদ'  থেকে পাই যে গৌতম বুদ্ধ বলছেন,
  ' অহিংসা সব্বপানামং অরিয়তি পবুদ্দতি '
   - অহিংসাকারীকেই লোকে  ' আর্য ' বলে ।
  আর্যরা  অহিংসক ছিলেন বলছি না,  বরং  আচরণের দ্বারাই  একজনকে আর্য ভাবা হত ।
  যে বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নতুন মত প্রতিষ্ঠা করলেন বুদ্ধ,  তিনি কিন্তু 'আর্য ' কথাটির প্রয়োগ করলেন গুণবাচক অর্থে । অর্থাৎ আর্য  ও বেদ সমার্থক নয় সবসময় ।
6। ঋগ্বেদ এ  'আর্য ' শব্দটি  32  বার ব্যবহৃত হয়েছে । বেদের ভাষ্যকার সায়ণাচার্য ' আর্য ' শব্দটির বিজ্ঞ , দেবোপাসক,  যজ্ঞানুষ্ঠাতা  ইত্যাদি  9 টি ব্যাখ্যা দিয়েছেন । অর্থাৎ  যজ্ঞকারী ছাড়াও  অনেককেই আর্য বলে চিহ্নিত করা হত ।
7। 'আর্যাবর্ত'  নামক স্থানের নাম দিয়ে  অনেকে সেখানে  আর্য জাতির বাস ছিল বলে মনে করেন । কোনও সংস্কৃতির লোক সংখ্যা গরিষ্ঠ হলে এরকম নামকরণ হয় অনেকসময়। হিন্দুস্থান,  পাকিস্তান  এর প্রমাণ ।
8।  আর্য  মানেই যে  যজ্ঞকারী নয় সেকথা  বলেছেন হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়  ( বৈদিক তত্ত্বে ভাষা বিজ্ঞান )। তার মতে  আর্যরা দুভাগ
 - যাজ্ঞিক  ও
- অযাজ্ঞিক ।
  অযাজ্ঞিক রা অগ্নি পূজা করত না ।
  যাজ্ঞিক  আর্যরা  আবার দুভাগে বিভক্ত ।
- অসূর্য ( অসুর সম্প্রদায় )
- দেবযাজি  ( দেব ব্রাহ্মণ followers )
   অসুর সম্প্রদায় শুনে গল্প কথা ভাববেন না । cencus  report অনুযায়ী ছোটনাগপুর  অঞ্চলে অসুর সম্প্রদায়  এখনও আছে ।  এমনকি  এই বাংলায়  জলপাইগুড়ি র কালচিনি তে আছেন  ( সংবাদ প্রতিদিন 20.9.2009)।
9।   ঋগ্বেদ এ 'অসুর' শব্দটি  105 বার প্রয়োগ হয়েছে । তার মধ্যেও  50  বার  বরুণ, ইন্দ্র, রুদ্র  ইত্যাদি দেবতা সম্পর্কে । এই দেবতারাই নাকি  অসুর !!
   অসুর সম্প্রদায়ের সকলেই যাজ্ঞিক ছিলেন না অবশ্য।
10।  তাহলে আমরা দেখছি  ব্রাহ্মণ - অব্রাহ্মণ-অসুর সকলকে নিয়ে ছিল আর্য সমাজ । একে একটি genetc গোষ্ঠী দিয়ে identify করা কিভাবে সম্ভব  !!
11। যজ্ঞের  বাইরেও  ধর্মভাবনার কথা ঋগ্বেদ  এ আছে ।
- 'ঋত' ভাবনা,  যাকে Winternitz বলেছেন 'order of universe'.( 1/151/3 etc)
-  বিপরীত বিশ্বাসী  লিঙ্গ পূজকদের কথা আছে । 7/21/15 etc
-  আছে উষা,  অদিতি নামক  দেবী ভাবনা
- যতি  বা যোগীদের কথা  ( ঐতরেয়,  শতপথ ব্রাহ্মণ )
  ভারত বরাবরই  বৈচিত্র্য এর দেশ । সেখানে  একদল লোক  ইউরোপ থেকে এসে বৈদিক সভ্যতার সৃষ্টি করল,  এরকম মোটেই নয় ।  উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা তাদের বংশধর এবং  এরাই  3000 বছর ধরে এদেশ নিয়ন্ত্রণ করছে,  এই ভাবনা টাও পুরো সত্যি নয় ।
12।  হরপ্পা  সংস্কৃতির  এলাকাকে  বাদ দিলে  পরে থাকে  UP,  বিহার যা আমরা বৈদিক সংস্কৃতির পীঠস্থান বলে চিহ্নিত করি । মুশকিল হল  পাথুরে প্রমাণ বলতে সেসব জায়গাতে বৈদিক নিদর্শনগুলি  1000  BC র অনেক পরে,  মূলতঃ  16  জনপদ  তথা  বৌদ্ধ যুগের ।
  মুশকিল হল বৌদ্ধ সংস্কৃতির জন্মই হল বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধিতায় । তাহলে  বৈদিক এর আগের  এ নিয়ে দ্বিধা নেই । কিন্ত প্রশ্ন হল,  কত আগের  ?
13।  1500 না  2500  BC নাকি তারও  আগের  ?  সবমতের  লোকেরাই হাতরে চলেছেন ।  আমরা  দেখলাম যে  1500 BC  র পরবর্তীকালীন হঠাৎই কোনও Cultural পরিবর্তন বিশেষ নেই ।
   এই উপমহাদেশেই  এই সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল  এমনটাই তো  মনে হয় ।
- বাইরে থেকে এই সংস্কৃতি আসেনি কারণ  কিছু পরিচিত  শব্দ বাদ দিলে সংস্কৃত ভাষার কোনও নিদর্শন বাইরে নেই ।
- লিপি আর ভাষা এক নয় । সমুদ্র গুপ্তের মুদ্রা দেখলে বুঝতে পারব যে তার ভাষা সংস্কৃত কিন্তু লিপি ব্রাহ্মী ।
- ধম্মপদ পাঠ করলে দেখব যে বুদ্ধের ভাষা অনেকটাই সংস্কৃত ঘেষা ।
- অশোকের শিলালিপির ভাষা পালি হলেও  চেষ্টা করলে সংস্কৃত জানা মানুষ পাঠ করতে পারবেন ।
- সংস্কৃত নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে কোন একটা চালু ভাষা সংস্কার করে এর জন্ম ।
    এসব ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এই ইঙ্গিত দেয় এদেশের বুকে এক ক্রম বিবর্তনের ।
   মানুষ স্বভাবে migratory । নানা প্রাকৃতিক,  অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও  সামাজিক কারণে এদেশ থেকে ওদেশে যায় ।
    তেমনই  নানা সময়ে নানা মানুষ এসেছে ।  R1a1   haplogroup  এর মানুষেরাও হয়তো এসেছে । কিন্তু বহু বৈচিত্র্যময়  আর্য সভ্যতা তাদের হাত ধরে এসেছে এমনটা যেমন সত্যি নয় তেমনই  হরপ্পা সংস্কৃতির মধ্যে বৈদিক নানা  ভাগের কোনও বৈশিষ্ট্য ই ছিল না  এমনটাও নয় । কারণ  অগ্নিবেদী, অশ্ব, যোগী মূর্তি,  ইত্যাদি অনেক কিছুর পাথুরে নিদর্শন তাদের এলাকাতেও পেয়েছি ।
    আর্য  সংস্কৃতির বাইরেও ভারতের জনমানসে শক্তি সাধকদের  এবং  লৌকিক দেব দেবীর পূজার কৃষ্টি ছিল,  যা তন্ত্র  বা শৈব নামে পরে আর্য সংস্কৃতিতে অংশীভূত হয় ।  সবাইকে নিয়েই  এই ভারতীয় সভ্যতা ।  বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের একচেটিয়াও ধারাবাহিক নয় ।
- মৌর্য  রাজবংশ  প্রথমে জৈন,  পরে বৌদ্ধ
- শুঙ্গ রাজবংশ  শুদ্র
- বাংলার পাল রাজবংশ  ( 500 বছর,  বিস্তৃতি  বিহার ছাড়িয়ে কখনও কনৌজ পর্যন্ত) বৌদ্ধ  ।
- হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ অনুরাগী।
- শক রাজারা বৌদ্ধ ।
- বৈশালীর রাজবংশের পুত্র মহাবীর জৈন ।
- কপিলাবস্তুর রাজপুত্র বুদ্ধ ।
  অবশ্যই ব্রাহ্মণ্যবাদী  রাজারাও আছেন ।  সবাইকে নিয়েই এ দেশের ইতিহাস ।    সব সংস্কৃতিকে একসাথে নিয়ে এই ভারত, এবং তার প্রাচীন সংস্কৃতি ।

Comments

Popular posts from this blog

কঠোপনিষদ ২০

উপনিষদ পর্ব 1

মহাভারত শ্লোক