বৈদিক সভ্যতা ও Archaeology. 4th Part
।। বৈদিক সভ্যতা ও Indian Archaeology ।।
পর্ব 4
।। যজ্ঞ, মৃত সৎকার, লোহা ইত্যাদি ।।
যজ্ঞ ও অগ্নিবেদী : -
বৈদিক সংস্কৃতির জোরালো নিদর্শন হল যজ্ঞ এবং যজ্ঞ করতে গেলে চাই অগ্নিবেদী। আমরা দেখে নেব যে 1400 BC র আগে এই উপমহাদেশে এর আগের সময়ে এর প্রত্ন প্রমাণ আছে কিনা !
- Sankalia দেখিয়েছেন বেলুচিস্তানের আমরি তে
- Rao দেখিয়েছেন লোথাল এ
- BB Lal দেখিয়েছেন কালিবঙ্গান এ
- লুধিয়ানা র দধোরি
এগুলো সবকটাই Late Harappan period এর ।
RS Sharma স্বীকার করেছেন যে বেলুচিস্তানের কচি সমতলে 1800 BC সময়ের কয়েকটি অগ্নিস্থল পাওয়া গেছে । এগুলোকে যজ্ঞবেদী বলে Sharma মানতে দ্বিধাগ্রস্থ ।
- দিলীপ কুমার চক্রবর্তী দেখিয়েছেন 'মালব সংস্কৃতি ' তে 2nd Millennium BC তে পাওয়া গেছে ।
তাহলে ঐ তথাকথিত আর্যদের আসার আগেই এসব রয়েছে ।
আবার উল্টোদিকে বলতে চাই যে, আর্যরা আসার (?) পরে কি প্রচুর নিদর্শন মিলেছে ? তাও তো নয় ।
- অত্রঞ্জিখেরা 1200 BC
- মথুরা 300 BC
- কৌশাম্বী 200 BC
খুব অল্প। মথুরা, কৌশাম্বী র কাল আবার বৌদ্ধ যুগের । তাহলে ?
মৃত সৎকার : -
বৈদিক তথা পরবর্তী হিন্দু সংস্কৃতিতে মৃত কে দাহ করাই সৎকারের একমাত্র পদ্ধতি মনে করা হয় । সম্পূর্ণ দাহ করে দগ্ধ নাভি বিসর্জন দিলে তার প্রত্ন প্রমাণ তো পাওয়া সম্ভব নয় ।
তবে RS Sharma 'শতপথ ব্রাহ্মণ ' এবং 'শ্রৌত সূত্র ও গৃহ্যসূত্র' -এর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন বহু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দাহ না করে অস্থি সংগ্রহ করা হত এবং অস্থিসহ সমাধি দেওয়া হত ।
আমরা প্রত্ন নিদর্শন গুলি দেখে নেব ।
- Vats ( Excavation at Harappa, 1941) হরপ্পা তে দাহ পরবর্তী সমাধি পেয়েছেন ।
- Marshall (1931) বেলুচিস্তানের সমাধিগুলিতে মানবাস্থি পেয়েছিলেন ।
ঋগ্বেদ ( 10/16/4) এ অন্তেষ্টিতে শবদেহের সাথে পশু দাহের কথা বলা আছে ।
অথর্ববেদে ও ( 12/2/48) এমন কথা আছে ।
Vats 175 টি ক্ষেত্রে দাহ পরবর্তী নিদর্শনে পশুর হাড়গোড় পেয়েছিলেন ।
তাহলে খুব বেশি পার্থক্য কি পাওয়া গেল ?
লোহা :-
Chalcolithic period হল তামা -ব্রোঞ্জ এর যুগ । সিন্ধু সভ্যতার রমরমা এই ধাতুর ব্যবহারের উপরেই দাড়িয়ে আছে । অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয় লোহার ব্যবহার হল আর্যদের USP । এর মাধ্যমেই তারা এই উপমহাদেশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন ।
একটু দেখে নিই I Habib এর তথ্য ( page 93-98) কি জানাচ্ছে । উত্তরপ্রদেশ, বিহার, যেখানে বৈদিক সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল ধরা হয় সেখানকার লোহার নিদর্শন হল
- আত্রাঞ্জিখেরা 640 BC
- উচ্চ গাঙ্গেয় অববাহিকা 800 BC
- নরহান 900 BC
- চিরান্দ 885 BC
- এমনকি বাংলার মহিষাদলে 820 BC
আমরা মনে রাখব যে তথাকথিত আর্যদের আগমনের তারিখ 1400 BC । কেউ বলতেই পারেন যে আর্যদের গুছিয়ে নিতে হয়তো 500 বছর লেগে গেছে ।
কিন্তু আরও গল্প আছে ! তথাকথিত আর্যদের ক্ষেত্র নয় এমন স্থানে যে আগেই লোহা পাওয়া গেল !! এও তো হাবিব সাহেবের বইতে পাচ্ছি ।
- মান্ডিগাক - 2300 BC র ( প্রাথমিক ' নরম লোহা ')
- সোয়াট 1200 BC
- মুঘল গুন্ডাই 1100-800 BC
- কর্নাটকের হাল্লুর 1385 BC
- কর্নাটকের কোমারানাহাল্লি 1440 BC
প্রথম তিনটি সিন্ধু সভ্যতার অংশ।
তাহলে এই উপমহাদেশে লোহার ব্যবহার এর জন্য আগত আর্যদের যুক্ত করার কোনও কারণ নেই ।
আসলে বাইরে থেকে কেউ বৈদিক কৃষ্টি নিয়ে আসে নি মোটেই । যে সোনালী পঞ্চভূজের কথা আলোচনা করছি আমরা তার ঠিক ধার ধরে প্রসারিত হয়েছিল ভারতীয় সভ্যতা । পূর্বে বাংলা, পশ্চিমে আফগানিস্তান, দক্ষিণে কেরল - কর্নাটক, উত্তরে কাশ্মীর অবধি এই সভ্যতার বিস্তার হয়ে গেছে 1000 BC র মধ্যেই ( যার শুরু 7000 BC নাগাদ )।
তাহলে এই চার পর্ব ধরে আমরা কিভাবে এই ইতিহাসকে দেখলাম একটু দেখে নিই বরং -
1। সোনালী পঞ্চভূজ যেটিকে বলছি সেটি আসলে চতুর্ভুজ, যার মধ্যে একটি কেন্দ্র রাজস্থানের বাগোর । একে মাঝে রেখেই পশ্চিমে মেহেরগড়ে, উত্তরে হরিয়ানার ভিরানা, পূবে Koldihwa - Jhusi এবং দক্ষিণে মধ্যপ্রদেশ এই চারটি কেন্দ্র কে যোগ করলে আমরা 7000 BC পরবর্তীকালীন কৃষি, পশুপালন সহ ধারাবাহিক যৌথ বসবাসের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি । ক্রমে ধাতুর ব্যবহার ও নানা পাত্রাদি Culture এর বিকাশ হচ্ছে ।
2। ক্রমশ এলাকার বিস্তার ঘটেছে । পশ্চিম দিকে নাগরিক কৃষ্টি, দক্ষিণে লোহার আবিস্কার এবং পূর্বে গ্রামীণ গবাদি কৃষ্টি র বিকাশ লক্ষ্যনীয় ।
3। বৈদিক মানে আমরা মনে করি একদল লোক যারা মন্ত্র পাঠ করে যজ্ঞ করত । যজ্ঞ মানেই অগ্নিবেদী ও তার চারপাশে ঋত্বিক, হোতা এসব ব্রাহ্মণ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ক্ষত্রিয় যজমান । এরাই হল আর্য !
4। কিন্ত এটি সম্পূর্ণ চিত্র নয় । সমগ্র আর্য সংস্কৃতির এক খন্ড অংশ। আর্য কোনও race তো মোটেই নয় । এটি একটি সংস্কৃতি । পাঞ্জাবি দের মধ্যে Genetic মিল থাকলেও শিখ , হিন্দু, মুসলমান পাঞ্জাবি সংস্কৃতিতে আলাদা হবেন । আবার উল্টোদিকে ভারতের উত্তর, পূর্ব বা দক্ষিণের মুসলমান কৃষ্টি তে এক হলেও genetically আলাদা হবেন । আর্য জাতি বা আর্য জিন বলে আসলে কিছু হয় না ।
5। 'ধম্মপদ' থেকে পাই যে গৌতম বুদ্ধ বলছেন,
' অহিংসা সব্বপানামং অরিয়তি পবুদ্দতি '
- অহিংসাকারীকেই লোকে ' আর্য ' বলে ।
আর্যরা অহিংসক ছিলেন বলছি না, বরং আচরণের দ্বারাই একজনকে আর্য ভাবা হত ।
যে বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নতুন মত প্রতিষ্ঠা করলেন বুদ্ধ, তিনি কিন্তু 'আর্য ' কথাটির প্রয়োগ করলেন গুণবাচক অর্থে । অর্থাৎ আর্য ও বেদ সমার্থক নয় সবসময় ।
6। ঋগ্বেদ এ 'আর্য ' শব্দটি 32 বার ব্যবহৃত হয়েছে । বেদের ভাষ্যকার সায়ণাচার্য ' আর্য ' শব্দটির বিজ্ঞ , দেবোপাসক, যজ্ঞানুষ্ঠাতা ইত্যাদি 9 টি ব্যাখ্যা দিয়েছেন । অর্থাৎ যজ্ঞকারী ছাড়াও অনেককেই আর্য বলে চিহ্নিত করা হত ।
7। 'আর্যাবর্ত' নামক স্থানের নাম দিয়ে অনেকে সেখানে আর্য জাতির বাস ছিল বলে মনে করেন । কোনও সংস্কৃতির লোক সংখ্যা গরিষ্ঠ হলে এরকম নামকরণ হয় অনেকসময়। হিন্দুস্থান, পাকিস্তান এর প্রমাণ ।
8। আর্য মানেই যে যজ্ঞকারী নয় সেকথা বলেছেন হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় ( বৈদিক তত্ত্বে ভাষা বিজ্ঞান )। তার মতে আর্যরা দুভাগ
- যাজ্ঞিক ও
- অযাজ্ঞিক ।
অযাজ্ঞিক রা অগ্নি পূজা করত না ।
যাজ্ঞিক আর্যরা আবার দুভাগে বিভক্ত ।
- অসূর্য ( অসুর সম্প্রদায় )
- দেবযাজি ( দেব ব্রাহ্মণ followers )
অসুর সম্প্রদায় শুনে গল্প কথা ভাববেন না । cencus report অনুযায়ী ছোটনাগপুর অঞ্চলে অসুর সম্প্রদায় এখনও আছে । এমনকি এই বাংলায় জলপাইগুড়ি র কালচিনি তে আছেন ( সংবাদ প্রতিদিন 20.9.2009)।
9। ঋগ্বেদ এ 'অসুর' শব্দটি 105 বার প্রয়োগ হয়েছে । তার মধ্যেও 50 বার বরুণ, ইন্দ্র, রুদ্র ইত্যাদি দেবতা সম্পর্কে । এই দেবতারাই নাকি অসুর !!
অসুর সম্প্রদায়ের সকলেই যাজ্ঞিক ছিলেন না অবশ্য।
10। তাহলে আমরা দেখছি ব্রাহ্মণ - অব্রাহ্মণ-অসুর সকলকে নিয়ে ছিল আর্য সমাজ । একে একটি genetc গোষ্ঠী দিয়ে identify করা কিভাবে সম্ভব !!
11। যজ্ঞের বাইরেও ধর্মভাবনার কথা ঋগ্বেদ এ আছে ।
- 'ঋত' ভাবনা, যাকে Winternitz বলেছেন 'order of universe'.( 1/151/3 etc)
- বিপরীত বিশ্বাসী লিঙ্গ পূজকদের কথা আছে । 7/21/15 etc
- আছে উষা, অদিতি নামক দেবী ভাবনা
- যতি বা যোগীদের কথা ( ঐতরেয়, শতপথ ব্রাহ্মণ )
ভারত বরাবরই বৈচিত্র্য এর দেশ । সেখানে একদল লোক ইউরোপ থেকে এসে বৈদিক সভ্যতার সৃষ্টি করল, এরকম মোটেই নয় । উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা তাদের বংশধর এবং এরাই 3000 বছর ধরে এদেশ নিয়ন্ত্রণ করছে, এই ভাবনা টাও পুরো সত্যি নয় ।
12। হরপ্পা সংস্কৃতির এলাকাকে বাদ দিলে পরে থাকে UP, বিহার যা আমরা বৈদিক সংস্কৃতির পীঠস্থান বলে চিহ্নিত করি । মুশকিল হল পাথুরে প্রমাণ বলতে সেসব জায়গাতে বৈদিক নিদর্শনগুলি 1000 BC র অনেক পরে, মূলতঃ 16 জনপদ তথা বৌদ্ধ যুগের ।
মুশকিল হল বৌদ্ধ সংস্কৃতির জন্মই হল বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধিতায় । তাহলে বৈদিক এর আগের এ নিয়ে দ্বিধা নেই । কিন্ত প্রশ্ন হল, কত আগের ?
13। 1500 না 2500 BC নাকি তারও আগের ? সবমতের লোকেরাই হাতরে চলেছেন । আমরা দেখলাম যে 1500 BC র পরবর্তীকালীন হঠাৎই কোনও Cultural পরিবর্তন বিশেষ নেই ।
এই উপমহাদেশেই এই সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল এমনটাই তো মনে হয় ।
- বাইরে থেকে এই সংস্কৃতি আসেনি কারণ কিছু পরিচিত শব্দ বাদ দিলে সংস্কৃত ভাষার কোনও নিদর্শন বাইরে নেই ।
- লিপি আর ভাষা এক নয় । সমুদ্র গুপ্তের মুদ্রা দেখলে বুঝতে পারব যে তার ভাষা সংস্কৃত কিন্তু লিপি ব্রাহ্মী ।
- ধম্মপদ পাঠ করলে দেখব যে বুদ্ধের ভাষা অনেকটাই সংস্কৃত ঘেষা ।
- অশোকের শিলালিপির ভাষা পালি হলেও চেষ্টা করলে সংস্কৃত জানা মানুষ পাঠ করতে পারবেন ।
- সংস্কৃত নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে কোন একটা চালু ভাষা সংস্কার করে এর জন্ম ।
এসব ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এই ইঙ্গিত দেয় এদেশের বুকে এক ক্রম বিবর্তনের ।
মানুষ স্বভাবে migratory । নানা প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে এদেশ থেকে ওদেশে যায় ।
তেমনই নানা সময়ে নানা মানুষ এসেছে । R1a1 haplogroup এর মানুষেরাও হয়তো এসেছে । কিন্তু বহু বৈচিত্র্যময় আর্য সভ্যতা তাদের হাত ধরে এসেছে এমনটা যেমন সত্যি নয় তেমনই হরপ্পা সংস্কৃতির মধ্যে বৈদিক নানা ভাগের কোনও বৈশিষ্ট্য ই ছিল না এমনটাও নয় । কারণ অগ্নিবেদী, অশ্ব, যোগী মূর্তি, ইত্যাদি অনেক কিছুর পাথুরে নিদর্শন তাদের এলাকাতেও পেয়েছি ।
আর্য সংস্কৃতির বাইরেও ভারতের জনমানসে শক্তি সাধকদের এবং লৌকিক দেব দেবীর পূজার কৃষ্টি ছিল, যা তন্ত্র বা শৈব নামে পরে আর্য সংস্কৃতিতে অংশীভূত হয় । সবাইকে নিয়েই এই ভারতীয় সভ্যতা । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের একচেটিয়াও ধারাবাহিক নয় ।
- মৌর্য রাজবংশ প্রথমে জৈন, পরে বৌদ্ধ
- শুঙ্গ রাজবংশ শুদ্র
- বাংলার পাল রাজবংশ ( 500 বছর, বিস্তৃতি বিহার ছাড়িয়ে কখনও কনৌজ পর্যন্ত) বৌদ্ধ ।
- হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ অনুরাগী।
- শক রাজারা বৌদ্ধ ।
- বৈশালীর রাজবংশের পুত্র মহাবীর জৈন ।
- কপিলাবস্তুর রাজপুত্র বুদ্ধ ।
অবশ্যই ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজারাও আছেন । সবাইকে নিয়েই এ দেশের ইতিহাস । সব সংস্কৃতিকে একসাথে নিয়ে এই ভারত, এবং তার প্রাচীন সংস্কৃতি ।
পর্ব 4
।। যজ্ঞ, মৃত সৎকার, লোহা ইত্যাদি ।।
যজ্ঞ ও অগ্নিবেদী : -
বৈদিক সংস্কৃতির জোরালো নিদর্শন হল যজ্ঞ এবং যজ্ঞ করতে গেলে চাই অগ্নিবেদী। আমরা দেখে নেব যে 1400 BC র আগে এই উপমহাদেশে এর আগের সময়ে এর প্রত্ন প্রমাণ আছে কিনা !
- Sankalia দেখিয়েছেন বেলুচিস্তানের আমরি তে
- Rao দেখিয়েছেন লোথাল এ
- BB Lal দেখিয়েছেন কালিবঙ্গান এ
- লুধিয়ানা র দধোরি
এগুলো সবকটাই Late Harappan period এর ।
RS Sharma স্বীকার করেছেন যে বেলুচিস্তানের কচি সমতলে 1800 BC সময়ের কয়েকটি অগ্নিস্থল পাওয়া গেছে । এগুলোকে যজ্ঞবেদী বলে Sharma মানতে দ্বিধাগ্রস্থ ।
- দিলীপ কুমার চক্রবর্তী দেখিয়েছেন 'মালব সংস্কৃতি ' তে 2nd Millennium BC তে পাওয়া গেছে ।
তাহলে ঐ তথাকথিত আর্যদের আসার আগেই এসব রয়েছে ।
আবার উল্টোদিকে বলতে চাই যে, আর্যরা আসার (?) পরে কি প্রচুর নিদর্শন মিলেছে ? তাও তো নয় ।
- অত্রঞ্জিখেরা 1200 BC
- মথুরা 300 BC
- কৌশাম্বী 200 BC
খুব অল্প। মথুরা, কৌশাম্বী র কাল আবার বৌদ্ধ যুগের । তাহলে ?
মৃত সৎকার : -
বৈদিক তথা পরবর্তী হিন্দু সংস্কৃতিতে মৃত কে দাহ করাই সৎকারের একমাত্র পদ্ধতি মনে করা হয় । সম্পূর্ণ দাহ করে দগ্ধ নাভি বিসর্জন দিলে তার প্রত্ন প্রমাণ তো পাওয়া সম্ভব নয় ।
তবে RS Sharma 'শতপথ ব্রাহ্মণ ' এবং 'শ্রৌত সূত্র ও গৃহ্যসূত্র' -এর উদাহরণ দিয়ে বলেছেন বহু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দাহ না করে অস্থি সংগ্রহ করা হত এবং অস্থিসহ সমাধি দেওয়া হত ।
আমরা প্রত্ন নিদর্শন গুলি দেখে নেব ।
- Vats ( Excavation at Harappa, 1941) হরপ্পা তে দাহ পরবর্তী সমাধি পেয়েছেন ।
- Marshall (1931) বেলুচিস্তানের সমাধিগুলিতে মানবাস্থি পেয়েছিলেন ।
ঋগ্বেদ ( 10/16/4) এ অন্তেষ্টিতে শবদেহের সাথে পশু দাহের কথা বলা আছে ।
অথর্ববেদে ও ( 12/2/48) এমন কথা আছে ।
Vats 175 টি ক্ষেত্রে দাহ পরবর্তী নিদর্শনে পশুর হাড়গোড় পেয়েছিলেন ।
তাহলে খুব বেশি পার্থক্য কি পাওয়া গেল ?
লোহা :-
Chalcolithic period হল তামা -ব্রোঞ্জ এর যুগ । সিন্ধু সভ্যতার রমরমা এই ধাতুর ব্যবহারের উপরেই দাড়িয়ে আছে । অনেক ক্ষেত্রেই বলা হয় লোহার ব্যবহার হল আর্যদের USP । এর মাধ্যমেই তারা এই উপমহাদেশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন ।
একটু দেখে নিই I Habib এর তথ্য ( page 93-98) কি জানাচ্ছে । উত্তরপ্রদেশ, বিহার, যেখানে বৈদিক সভ্যতার বিকাশ হয়েছিল ধরা হয় সেখানকার লোহার নিদর্শন হল
- আত্রাঞ্জিখেরা 640 BC
- উচ্চ গাঙ্গেয় অববাহিকা 800 BC
- নরহান 900 BC
- চিরান্দ 885 BC
- এমনকি বাংলার মহিষাদলে 820 BC
আমরা মনে রাখব যে তথাকথিত আর্যদের আগমনের তারিখ 1400 BC । কেউ বলতেই পারেন যে আর্যদের গুছিয়ে নিতে হয়তো 500 বছর লেগে গেছে ।
কিন্তু আরও গল্প আছে ! তথাকথিত আর্যদের ক্ষেত্র নয় এমন স্থানে যে আগেই লোহা পাওয়া গেল !! এও তো হাবিব সাহেবের বইতে পাচ্ছি ।
- মান্ডিগাক - 2300 BC র ( প্রাথমিক ' নরম লোহা ')
- সোয়াট 1200 BC
- মুঘল গুন্ডাই 1100-800 BC
- কর্নাটকের হাল্লুর 1385 BC
- কর্নাটকের কোমারানাহাল্লি 1440 BC
প্রথম তিনটি সিন্ধু সভ্যতার অংশ।
তাহলে এই উপমহাদেশে লোহার ব্যবহার এর জন্য আগত আর্যদের যুক্ত করার কোনও কারণ নেই ।
আসলে বাইরে থেকে কেউ বৈদিক কৃষ্টি নিয়ে আসে নি মোটেই । যে সোনালী পঞ্চভূজের কথা আলোচনা করছি আমরা তার ঠিক ধার ধরে প্রসারিত হয়েছিল ভারতীয় সভ্যতা । পূর্বে বাংলা, পশ্চিমে আফগানিস্তান, দক্ষিণে কেরল - কর্নাটক, উত্তরে কাশ্মীর অবধি এই সভ্যতার বিস্তার হয়ে গেছে 1000 BC র মধ্যেই ( যার শুরু 7000 BC নাগাদ )।
তাহলে এই চার পর্ব ধরে আমরা কিভাবে এই ইতিহাসকে দেখলাম একটু দেখে নিই বরং -
1। সোনালী পঞ্চভূজ যেটিকে বলছি সেটি আসলে চতুর্ভুজ, যার মধ্যে একটি কেন্দ্র রাজস্থানের বাগোর । একে মাঝে রেখেই পশ্চিমে মেহেরগড়ে, উত্তরে হরিয়ানার ভিরানা, পূবে Koldihwa - Jhusi এবং দক্ষিণে মধ্যপ্রদেশ এই চারটি কেন্দ্র কে যোগ করলে আমরা 7000 BC পরবর্তীকালীন কৃষি, পশুপালন সহ ধারাবাহিক যৌথ বসবাসের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি । ক্রমে ধাতুর ব্যবহার ও নানা পাত্রাদি Culture এর বিকাশ হচ্ছে ।
2। ক্রমশ এলাকার বিস্তার ঘটেছে । পশ্চিম দিকে নাগরিক কৃষ্টি, দক্ষিণে লোহার আবিস্কার এবং পূর্বে গ্রামীণ গবাদি কৃষ্টি র বিকাশ লক্ষ্যনীয় ।
3। বৈদিক মানে আমরা মনে করি একদল লোক যারা মন্ত্র পাঠ করে যজ্ঞ করত । যজ্ঞ মানেই অগ্নিবেদী ও তার চারপাশে ঋত্বিক, হোতা এসব ব্রাহ্মণ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ক্ষত্রিয় যজমান । এরাই হল আর্য !
4। কিন্ত এটি সম্পূর্ণ চিত্র নয় । সমগ্র আর্য সংস্কৃতির এক খন্ড অংশ। আর্য কোনও race তো মোটেই নয় । এটি একটি সংস্কৃতি । পাঞ্জাবি দের মধ্যে Genetic মিল থাকলেও শিখ , হিন্দু, মুসলমান পাঞ্জাবি সংস্কৃতিতে আলাদা হবেন । আবার উল্টোদিকে ভারতের উত্তর, পূর্ব বা দক্ষিণের মুসলমান কৃষ্টি তে এক হলেও genetically আলাদা হবেন । আর্য জাতি বা আর্য জিন বলে আসলে কিছু হয় না ।
5। 'ধম্মপদ' থেকে পাই যে গৌতম বুদ্ধ বলছেন,
' অহিংসা সব্বপানামং অরিয়তি পবুদ্দতি '
- অহিংসাকারীকেই লোকে ' আর্য ' বলে ।
আর্যরা অহিংসক ছিলেন বলছি না, বরং আচরণের দ্বারাই একজনকে আর্য ভাবা হত ।
যে বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নতুন মত প্রতিষ্ঠা করলেন বুদ্ধ, তিনি কিন্তু 'আর্য ' কথাটির প্রয়োগ করলেন গুণবাচক অর্থে । অর্থাৎ আর্য ও বেদ সমার্থক নয় সবসময় ।
6। ঋগ্বেদ এ 'আর্য ' শব্দটি 32 বার ব্যবহৃত হয়েছে । বেদের ভাষ্যকার সায়ণাচার্য ' আর্য ' শব্দটির বিজ্ঞ , দেবোপাসক, যজ্ঞানুষ্ঠাতা ইত্যাদি 9 টি ব্যাখ্যা দিয়েছেন । অর্থাৎ যজ্ঞকারী ছাড়াও অনেককেই আর্য বলে চিহ্নিত করা হত ।
7। 'আর্যাবর্ত' নামক স্থানের নাম দিয়ে অনেকে সেখানে আর্য জাতির বাস ছিল বলে মনে করেন । কোনও সংস্কৃতির লোক সংখ্যা গরিষ্ঠ হলে এরকম নামকরণ হয় অনেকসময়। হিন্দুস্থান, পাকিস্তান এর প্রমাণ ।
8। আর্য মানেই যে যজ্ঞকারী নয় সেকথা বলেছেন হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় ( বৈদিক তত্ত্বে ভাষা বিজ্ঞান )। তার মতে আর্যরা দুভাগ
- যাজ্ঞিক ও
- অযাজ্ঞিক ।
অযাজ্ঞিক রা অগ্নি পূজা করত না ।
যাজ্ঞিক আর্যরা আবার দুভাগে বিভক্ত ।
- অসূর্য ( অসুর সম্প্রদায় )
- দেবযাজি ( দেব ব্রাহ্মণ followers )
অসুর সম্প্রদায় শুনে গল্প কথা ভাববেন না । cencus report অনুযায়ী ছোটনাগপুর অঞ্চলে অসুর সম্প্রদায় এখনও আছে । এমনকি এই বাংলায় জলপাইগুড়ি র কালচিনি তে আছেন ( সংবাদ প্রতিদিন 20.9.2009)।
9। ঋগ্বেদ এ 'অসুর' শব্দটি 105 বার প্রয়োগ হয়েছে । তার মধ্যেও 50 বার বরুণ, ইন্দ্র, রুদ্র ইত্যাদি দেবতা সম্পর্কে । এই দেবতারাই নাকি অসুর !!
অসুর সম্প্রদায়ের সকলেই যাজ্ঞিক ছিলেন না অবশ্য।
10। তাহলে আমরা দেখছি ব্রাহ্মণ - অব্রাহ্মণ-অসুর সকলকে নিয়ে ছিল আর্য সমাজ । একে একটি genetc গোষ্ঠী দিয়ে identify করা কিভাবে সম্ভব !!
11। যজ্ঞের বাইরেও ধর্মভাবনার কথা ঋগ্বেদ এ আছে ।
- 'ঋত' ভাবনা, যাকে Winternitz বলেছেন 'order of universe'.( 1/151/3 etc)
- বিপরীত বিশ্বাসী লিঙ্গ পূজকদের কথা আছে । 7/21/15 etc
- আছে উষা, অদিতি নামক দেবী ভাবনা
- যতি বা যোগীদের কথা ( ঐতরেয়, শতপথ ব্রাহ্মণ )
ভারত বরাবরই বৈচিত্র্য এর দেশ । সেখানে একদল লোক ইউরোপ থেকে এসে বৈদিক সভ্যতার সৃষ্টি করল, এরকম মোটেই নয় । উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা তাদের বংশধর এবং এরাই 3000 বছর ধরে এদেশ নিয়ন্ত্রণ করছে, এই ভাবনা টাও পুরো সত্যি নয় ।
12। হরপ্পা সংস্কৃতির এলাকাকে বাদ দিলে পরে থাকে UP, বিহার যা আমরা বৈদিক সংস্কৃতির পীঠস্থান বলে চিহ্নিত করি । মুশকিল হল পাথুরে প্রমাণ বলতে সেসব জায়গাতে বৈদিক নিদর্শনগুলি 1000 BC র অনেক পরে, মূলতঃ 16 জনপদ তথা বৌদ্ধ যুগের ।
মুশকিল হল বৌদ্ধ সংস্কৃতির জন্মই হল বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধিতায় । তাহলে বৈদিক এর আগের এ নিয়ে দ্বিধা নেই । কিন্ত প্রশ্ন হল, কত আগের ?
13। 1500 না 2500 BC নাকি তারও আগের ? সবমতের লোকেরাই হাতরে চলেছেন । আমরা দেখলাম যে 1500 BC র পরবর্তীকালীন হঠাৎই কোনও Cultural পরিবর্তন বিশেষ নেই ।
এই উপমহাদেশেই এই সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল এমনটাই তো মনে হয় ।
- বাইরে থেকে এই সংস্কৃতি আসেনি কারণ কিছু পরিচিত শব্দ বাদ দিলে সংস্কৃত ভাষার কোনও নিদর্শন বাইরে নেই ।
- লিপি আর ভাষা এক নয় । সমুদ্র গুপ্তের মুদ্রা দেখলে বুঝতে পারব যে তার ভাষা সংস্কৃত কিন্তু লিপি ব্রাহ্মী ।
- ধম্মপদ পাঠ করলে দেখব যে বুদ্ধের ভাষা অনেকটাই সংস্কৃত ঘেষা ।
- অশোকের শিলালিপির ভাষা পালি হলেও চেষ্টা করলে সংস্কৃত জানা মানুষ পাঠ করতে পারবেন ।
- সংস্কৃত নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে কোন একটা চালু ভাষা সংস্কার করে এর জন্ম ।
এসব ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা এই ইঙ্গিত দেয় এদেশের বুকে এক ক্রম বিবর্তনের ।
মানুষ স্বভাবে migratory । নানা প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে এদেশ থেকে ওদেশে যায় ।
তেমনই নানা সময়ে নানা মানুষ এসেছে । R1a1 haplogroup এর মানুষেরাও হয়তো এসেছে । কিন্তু বহু বৈচিত্র্যময় আর্য সভ্যতা তাদের হাত ধরে এসেছে এমনটা যেমন সত্যি নয় তেমনই হরপ্পা সংস্কৃতির মধ্যে বৈদিক নানা ভাগের কোনও বৈশিষ্ট্য ই ছিল না এমনটাও নয় । কারণ অগ্নিবেদী, অশ্ব, যোগী মূর্তি, ইত্যাদি অনেক কিছুর পাথুরে নিদর্শন তাদের এলাকাতেও পেয়েছি ।
আর্য সংস্কৃতির বাইরেও ভারতের জনমানসে শক্তি সাধকদের এবং লৌকিক দেব দেবীর পূজার কৃষ্টি ছিল, যা তন্ত্র বা শৈব নামে পরে আর্য সংস্কৃতিতে অংশীভূত হয় । সবাইকে নিয়েই এই ভারতীয় সভ্যতা । বর্ণ হিন্দু ব্রাহ্মণদের একচেটিয়াও ধারাবাহিক নয় ।
- মৌর্য রাজবংশ প্রথমে জৈন, পরে বৌদ্ধ
- শুঙ্গ রাজবংশ শুদ্র
- বাংলার পাল রাজবংশ ( 500 বছর, বিস্তৃতি বিহার ছাড়িয়ে কখনও কনৌজ পর্যন্ত) বৌদ্ধ ।
- হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ অনুরাগী।
- শক রাজারা বৌদ্ধ ।
- বৈশালীর রাজবংশের পুত্র মহাবীর জৈন ।
- কপিলাবস্তুর রাজপুত্র বুদ্ধ ।
অবশ্যই ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজারাও আছেন । সবাইকে নিয়েই এ দেশের ইতিহাস । সব সংস্কৃতিকে একসাথে নিয়ে এই ভারত, এবং তার প্রাচীন সংস্কৃতি ।
Comments
Post a Comment