Sandip manna 1
#ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য জাতি তত্ত্ব - (পর্ব - ১)
================================
পুরাণের গল্পগুলি পড়তে বেশ লাগে। এমনকি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় এই গল্পগুলি আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের সুমহান ইতিহাস। এই ইচ্ছেটা যখন প্রবল হয়, আমরা বিশ্বাস করেও ফেলি। পুরাণের সুদূর অতীতের কল্পকাহিনীগুলি এমনভাবে কাল ও পাত্রের ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে বর্তমান মানচিত্র ধরে ধরে নির্দিষ্ট স্থানও মেলানো হয়ে যায়। আসলে এই ধরণের গল্পগুলি আমাদের ভাবনায় আরামের সুড়সুড়ি দেয়। আর আরাম কে না চায় বলুন?
ইতিহাস বলতে আমরা তো বুঝি ‘ইতি-হ-আস’। যার অর্থ, অতীতে যা ঘটেছিল। অর্থাৎ কোন অতীত ঘটনার নির্দিষ্ট স্থান কাল ও পাত্রের সমন্বয় এবং কোনভাবেই সেই সমন্বয়ের পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয় (যতই বলা হোক না কেন, History repeats itself)। অবশ্যই ইতিহাসের নির্দিষ্ট উপাদানসমূহ আছে, যার ভিত্তিতেই ইতিহাস লেখা হয় এবং নতুন নতুন তথ্যের আলোয় নতুন করে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করা হয়। তাই ইতিহাস এক কালের প্রবাহ, ইতিহাস এক বহমানতা। অন্যদিকে দেখুন, পুরাণগুলি নিরবধিকাল একই গল্প থুড়ি ‘ঐতিহাসিক কাহিনী’ বলে আসছে। মজার কথা এটাই সেই গল্পগুলির অনেকগুলিই বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন রূপে বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ গল্পগুলির নির্দিষ্টতা বলে কিছু নেই। সেই গল্পগুলিই পুরাতত্ত্বের চাটনিতে মাখিয়ে ইতিহাস বলে এমনভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে, প্রশিক্ষিত মানুষজনই যথেষ্ট ঘাবড়ে যাচ্ছেন। সেখানে আমি আর আপনি? ধুসস্!!!
তাহলে একটা কথা সার বুঝে গেলাম, ‘ইতিহাস’ বলে যাই বলা হোক না কেন, আমরা প্রতিটি তথ্যে সন্দেহপ্রবণ হবো এবং অবশ্যই জিজ্ঞাসার তুমুলকরণ জারি থাকবে। We always need to ask: In whose interest is it that the past should be presented to us in this way?
বৈদিক যুগ
---------------
ইস্কুলের ইতিহাস বইতে হরপ্পা (সিন্ধু) সভ্যতার পরের চ্যাপ্টারেই আমদের পড়তে হয় বৈদিক যুগ। এই বৈদিক যুগ আবার দুটি সময়কালে বিভাজিত, ১) ঋকবৈদিক যুগ (১৫০০ খ্রিঃপূঃ. - ১০০০ খ্রিঃপূঃ) এবং ২) পরবর্তী বৈদিক যুগ (১০০০ খ্রিঃপূঃ - ৬০০ খ্রিঃপূঃ)। পরবর্তী বৈদিক যুগ অর্থে সাধারণত বোঝানো হয় যে সময়কালে সাম, যজুঃ ও অথর্ববেদ রচিত হয়েছিল।
আচ্ছা কয়েকটা প্রশ্ন করি, সারা ভারতীয় উপমহাদেশের সব মানুষই কি তখন বৈদিক হয়ে গেছিলেন? এই বিশাল উপমহাদেশের কোনো স্থানে অন্য কোন সংস্কৃতি কি ছিল না? অন্য কোন ধরণের জীবনযাপন কি ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। অবশ্যই ছিল। ইতিহাসের প্রাক-পর্যায় (Pre-history) থেকেই আমরা সে কথা জানতে পারি। তাহলে সেগুলোর কথা চেপে যাওয়া হয় কেন? তখনই উত্তর আসে, সেইসবের উপাদান পাওয়া যায়নি বলে গুহ্য কথা উহ্য থাকে।
আচ্ছা বলুন তো, এই যে ‘বেদ’, এর সূক্তগুলির অর্থের কোন সর্বগ্রাহ্য মান্যতা আছে? বিভিন্ন মন্ডলের সর্বগ্রাহ্য স্তরবিভাগ আছে? রচনার সর্বগ্রাহ্য সময়কাল আছে? এর কোন সমসাময়িক লিখিত উপাদান আছে? পাথুরে প্রমাণ আছে? ভাষার ঠিক-ঠিকানা আছে? এমনকি কবে কারা সেই রচনাগুলি সৃষ্টি করেছিলেন এবং কারা লিখিত আকারে সংকলিত করেছিলেন, তাঁর কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ আছে? নেই, কিচ্ছু নেই। অথচ আমাদের কিনা মানতেই হবে ১৫০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ৬০০ খ্রিঃপূঃ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস মানে ‘সুমহান বৈদিক যুগ’, এবং বাদবাকি আর কিচ্ছু নেই। আজ্ঞে হ্যাঁ, ইহাই হইল সাংস্কৃতিক-রাজনীতি।
বৈদিক যুগের ছাগল-ভেড়া চড়ানো এবং জোয়ার, বাজরা, ধান ফলানো আধা-পশুপালক আধা-কৃষক লোকগুলো হঠাৎ করে ফস্সা ফস্সা, দীর্ঘদেহী, খড়্গনাসা, দীর্ঘ করোটি, ব্লন্ড কেশরাশি, নিমীলিতচক্ষু আর্য ঋষি-মুনি হয়ে গিয়ে দক্ষিণহস্তে ধ্যানমুদ্রা এবং কেলে-কেলে, বেঁটে-বেঁটে, নাক চ্যাপটা, কোঁকড়ানো চুলের অনার্যদের বামহস্তে ঘাড় ধরে ‘আয় তোদের সভ্যতা শেখাই, নয়তো বনেবাদাড়ে গিয়ে চু কিত কিত খেলগে যা’ - এইসব কল্পিত কাহিনীগুলি ছোটবেলা থেকে বারবার এমনভাবেই আমাদের ‘ইতিহাস’ বলে শেখানো হয়, যা আজও ‘ইতিহাস’ বলেই আমাদের মনের গভীরে গেঁথে আছে। আর কোনো কোনো ঐতিহাসিকরা(!) এই ধর্মীয়-কাল্পনিক কাহিনীগুলিকে ইতিহাস-পুরাতত্ত্বের আরকে মাখিয়ে বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মতবাদ (Socio-Political Doctrine) প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে এমনভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রায়-পর্যায় (Proto-history) লিখে যাচ্ছেন যা আমাদের মনে ক্রমশ ওপরের বিশ্বাসগুলোই সুদৃঢ় করে তুলছে।
এবং আমি ও আপনি, আজ্ঞে হ্যাঁ আমি ও আপনি, আসুন একহাত ইতিহাস হয়ে যাক বলে পুরাণ, ইতিহাস, এর ওর তার লেখা ইতিহাস নামে গপ্পের বই, নিজ মস্তিষ্কের গপ্পো মিশিয়ে ভারতীয় ইতিহাসের প্রায়-পর্যায় নিয়ে গলায় মালা দুলিয়ে দু’হাত তুলে কেত্তন করছি। এবং বিশ্বাস করুন স্যার ও ম্যাডাম মহোদয়/দয়াগণ আমরা কিন্তু সবাই মিলেই সেইগুলো তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি।
ভাষাতত্ত্ব না আমসত্ব
----------------------------
পৃথিবীর কোন ভাষাতেই মৌখিক আর লিখিত ভাষা কি এক? আপনাদের কাছে আমার এই প্রশ্ন জারি রইল। আমরা যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করি, সেই ভাষাতেই কি কথা বলি? পুরুলিয়ার কিংবা সিলেটের মানুষ যাঁরা প্রত্যেকেই বাংলাভাষী, তাঁরা যখন বাংলাভাষায় লেখেন, বিশেষ করে ধর্মীয় কাহিনী, তাঁদের লেখা কি তাঁদের কথ্য ভাষায় লেখেন? না, কখনই নয়। অথচ ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন লিখিত ঋগ্বেদের ভাষাতেই সেইযুগের মানুষেরা কথা বলতেন।
ক্ষী আশ্চুর্যি, বলিহারি বুদ্দি বটে!
আমাদের পঠিত ইতিহাস বলে, বেদ-এর অপর নাম শ্রুতি, কেননা, সুদীর্ঘকাল ধরে তার স্তোত্রগুলি গুরুশিষ্য পরম্পরায় মৌখিকভাবেই রচিত ও মুখস্ত করা হয়ে আসছে। এই বেদ-এর প্রথমভাগ হল, ঋগ্বেদ। পাণিনি বলে এক ভদ্রলোক সংস্কৃত ভাষায় ‘অষ্ট্যাধ্যায়ী’ নামে এক ব্যাকরণগ্রন্থ লিখেছিলেন, ঐ ধরুন ৫০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ। তিনি সেই বইতে সংস্কৃত ভাষার কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, যাতে ভাষাটি এলোমেলো না হয়ে যায়। এখন মজা হল, এই সংস্কৃত ভাষার থেকে নাকি ঋগ্বেদের ভাষা প্রাচীন ও পৃথক। এবার মঞ্চে প্রবেশ যাস্ক নামক এক ভদ্রলোকের। যাস্ক তাঁর নিরুক্ত গ্রন্থে ঋগ্বেদ-এর ব্যাখ্যা করেছেন, ভাষ্য রচনা করেছেন সংস্কৃত ভাষায়। কেন? না তৎকালের পণ্ডিতরা ঋগ্বেদের ভাষাই বুঝতে পারছেন না, তাই ঋগ্বেদকে তখনকার কথ্যভাষা সংস্কৃতয় বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
তাহলে ঋগ্বেদ রচিত হল কোন ভাষায়?
‘Indo-Aryan’ - আকাশ থেকে ভেসে এল বানী।
তা এই Indo-Aryan-টা কি বস্তু?
Proto-Indo-European Language হল, ‘সভ্যতার জন্মভূমির ভাষা’। সেখান থেকে বিভিন্ন দলের পশুচারক ও পালকরা বিভিন্ন দিকে হাঁটা লাগাল। তারই মধ্যে একদল পশুচারক ও পালক হেঁটে হেঁটে যখন পা ব্যথা করতে লাগল, তখন ইরানে একটা লাঞ্চব্রেক দিলো। তখন তারা যে ভাষায় কথা বলত তার নাম হল, Indo-Iranian। জন্ম হল ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’-র। তারপর, আবেস্তার ভাষায় (Indo-Iranian) কথা বলা লোকগুলোর মধ্যে কোনও কোনও বিষয় (যেমন, দেব-দেবতা সংক্রান্ত - অগ্নি বড় না ইন্দ্র বড় ইত্যাদি) নিয়ে লাগল তুমুল ঝগড়া। তখন তাদের মধ্যে থেকে একদল (ইন্দ্রের সমর্থকরা) রাগ করে হাঁটা লাগাল আরও দক্ষিণ-পুবে। এদিকে হল কি, যত হাঁটছে তত তাদের কথ্যভাষা পাল্টাচ্ছে। পাল্টাতে পাল্টাতে তারা যখন হিন্দুকুশ টপকাল, বদলে যাওয়া আবহাওয়ায় এসে পড়ল, তখন সিন্ধুর বিমোহিত রূপ দেখে উদ্বেল হয়ে গিয়ে তাদের কথ্যভাষাটাই পাল্টে হয়ে গেল Indo-Aryan।
কি মজার গল্প না!
ভারতীয় উপমাহাদেশে এসে এদিক ওদিক গরু, ভেড়া, ছাগল চড়াতে চড়াতে আর তাদের ন্যাজ মুচড়ে হ্যাট হ্যাট করতে করতে সেই মানুষগুলি Indo-Aryan ভাষায় রচনা করে ফেলল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম গ্রন্থ - ঋগ্বেদ। পরবর্তীকালে ঋগ্বেদ যখন লিখিত আকারে সংস্কৃত ভাষায় সংকলিত হল, তখন শ্রুত হওয়া ঋগ্বেদের Indo-Aryan ভাষাটাই পাল্টে গেল। মুখে মুখে রচিত ও গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখস্ত করা স্তোত্রগুলির অর্থও কি পাল্টাল? স্তোত্রগুলো কথ্য Indo-Aryan থেকে ব্যাকরণ কাঠামো-সমৃদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় লিখতে গিয়ে কি একই অর্থ বহন করল? কোন লিপিতে লেখা হল, ব্রাহ্মী না দেবনাগরী নাকি অন্য কোন লিপিতে? প্রথমবার যে লিপিতে লেখা হল, সেই লিপিতে লেখা মূল পুঁথিগুলির হদিশ কেউ জানেন?
ইওরোপিয়ান ভাষাতাত্ত্বিকদের এই পুরো গপ্পোটা মানতে গেলে আমাদের মেনে নিতেই হবে, ৩৫০০ বছর আগে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বৈদিক মানুষেরা ঋগ্বেদের ভাষার মতো একটি ধর্মীয়, নাটুকে, কাব্যের ভাষায় সমাজে কথা বলতেন!
ভাষা-ভাষা ভাই-ভাই
----------------------------
১৭৮৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী, স্যার উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল-এর সভায় এক ভাষণে বললেন, সংস্কৃতর সঙ্গে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক, রোমান, কেল্টিক ও অন্যান্য ইওরোপিয়ান ভাষার বহু সাদৃশ্য পেয়েছেন। একজন আইনজীবী, ভাষাতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিচারক হিসেবে তাঁর সেই কথার ওজনই আলাদা মাত্রার হয়ে উঠল। জোন্স মশাই-এর এই ভাষা-সাদৃশ্যের তত্ত্বের ভাষন দেওয়ার ‘সময়’টা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন?
১) অর্থনৈতিক - সেইসময়ই আমেরিকার বেশিরভাগ উপনিবেশগুলো ব্রিটিশদের হাতছাড়া হয়ে গেছিল এবং উপায়হীন ব্রিটিশরা বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেছিল,
২) রাজনৈতিক - ইওরোপে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের (Nation-State) উদ্ভব শুরু হয়েছিল। সুতরাং 'এক জাতি - এক প্রাণ - একতা' এই আবেগটির প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল।
৩) সাংস্কৃতিক - ক) বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যপ্রমাণে মনুষ্য-উৎপত্তির বাইবেলগত ধারণা পরিত্যক্ত হয়ে গেছিল, এবং খ) সদ্য উপনিবেশ তৈরি হওয়া ভারতে হিন্দু উচ্চবর্ণের নিজস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্ব সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল।
ক্রমশ...
২য় পর্বের লিংক -
https://www.facebook.com/groups/sukumarray/permalink/2352187834796562/
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য জাতি তত্ত্ব - (পর্ব - ১)
================================
পুরাণের গল্পগুলি পড়তে বেশ লাগে। এমনকি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় এই গল্পগুলি আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের সুমহান ইতিহাস। এই ইচ্ছেটা যখন প্রবল হয়, আমরা বিশ্বাস করেও ফেলি। পুরাণের সুদূর অতীতের কল্পকাহিনীগুলি এমনভাবে কাল ও পাত্রের ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে বর্তমান মানচিত্র ধরে ধরে নির্দিষ্ট স্থানও মেলানো হয়ে যায়। আসলে এই ধরণের গল্পগুলি আমাদের ভাবনায় আরামের সুড়সুড়ি দেয়। আর আরাম কে না চায় বলুন?
ইতিহাস বলতে আমরা তো বুঝি ‘ইতি-হ-আস’। যার অর্থ, অতীতে যা ঘটেছিল। অর্থাৎ কোন অতীত ঘটনার নির্দিষ্ট স্থান কাল ও পাত্রের সমন্বয় এবং কোনভাবেই সেই সমন্বয়ের পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয় (যতই বলা হোক না কেন, History repeats itself)। অবশ্যই ইতিহাসের নির্দিষ্ট উপাদানসমূহ আছে, যার ভিত্তিতেই ইতিহাস লেখা হয় এবং নতুন নতুন তথ্যের আলোয় নতুন করে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করা হয়। তাই ইতিহাস এক কালের প্রবাহ, ইতিহাস এক বহমানতা। অন্যদিকে দেখুন, পুরাণগুলি নিরবধিকাল একই গল্প থুড়ি ‘ঐতিহাসিক কাহিনী’ বলে আসছে। মজার কথা এটাই সেই গল্পগুলির অনেকগুলিই বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন রূপে বলা হয়েছে। অর্থ্যাৎ গল্পগুলির নির্দিষ্টতা বলে কিছু নেই। সেই গল্পগুলিই পুরাতত্ত্বের চাটনিতে মাখিয়ে ইতিহাস বলে এমনভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে, প্রশিক্ষিত মানুষজনই যথেষ্ট ঘাবড়ে যাচ্ছেন। সেখানে আমি আর আপনি? ধুসস্!!!
তাহলে একটা কথা সার বুঝে গেলাম, ‘ইতিহাস’ বলে যাই বলা হোক না কেন, আমরা প্রতিটি তথ্যে সন্দেহপ্রবণ হবো এবং অবশ্যই জিজ্ঞাসার তুমুলকরণ জারি থাকবে। We always need to ask: In whose interest is it that the past should be presented to us in this way?
বৈদিক যুগ
---------------
ইস্কুলের ইতিহাস বইতে হরপ্পা (সিন্ধু) সভ্যতার পরের চ্যাপ্টারেই আমদের পড়তে হয় বৈদিক যুগ। এই বৈদিক যুগ আবার দুটি সময়কালে বিভাজিত, ১) ঋকবৈদিক যুগ (১৫০০ খ্রিঃপূঃ. - ১০০০ খ্রিঃপূঃ) এবং ২) পরবর্তী বৈদিক যুগ (১০০০ খ্রিঃপূঃ - ৬০০ খ্রিঃপূঃ)। পরবর্তী বৈদিক যুগ অর্থে সাধারণত বোঝানো হয় যে সময়কালে সাম, যজুঃ ও অথর্ববেদ রচিত হয়েছিল।
আচ্ছা কয়েকটা প্রশ্ন করি, সারা ভারতীয় উপমহাদেশের সব মানুষই কি তখন বৈদিক হয়ে গেছিলেন? এই বিশাল উপমহাদেশের কোনো স্থানে অন্য কোন সংস্কৃতি কি ছিল না? অন্য কোন ধরণের জীবনযাপন কি ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। অবশ্যই ছিল। ইতিহাসের প্রাক-পর্যায় (Pre-history) থেকেই আমরা সে কথা জানতে পারি। তাহলে সেগুলোর কথা চেপে যাওয়া হয় কেন? তখনই উত্তর আসে, সেইসবের উপাদান পাওয়া যায়নি বলে গুহ্য কথা উহ্য থাকে।
আচ্ছা বলুন তো, এই যে ‘বেদ’, এর সূক্তগুলির অর্থের কোন সর্বগ্রাহ্য মান্যতা আছে? বিভিন্ন মন্ডলের সর্বগ্রাহ্য স্তরবিভাগ আছে? রচনার সর্বগ্রাহ্য সময়কাল আছে? এর কোন সমসাময়িক লিখিত উপাদান আছে? পাথুরে প্রমাণ আছে? ভাষার ঠিক-ঠিকানা আছে? এমনকি কবে কারা সেই রচনাগুলি সৃষ্টি করেছিলেন এবং কারা লিখিত আকারে সংকলিত করেছিলেন, তাঁর কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ আছে? নেই, কিচ্ছু নেই। অথচ আমাদের কিনা মানতেই হবে ১৫০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ৬০০ খ্রিঃপূঃ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস মানে ‘সুমহান বৈদিক যুগ’, এবং বাদবাকি আর কিচ্ছু নেই। আজ্ঞে হ্যাঁ, ইহাই হইল সাংস্কৃতিক-রাজনীতি।
বৈদিক যুগের ছাগল-ভেড়া চড়ানো এবং জোয়ার, বাজরা, ধান ফলানো আধা-পশুপালক আধা-কৃষক লোকগুলো হঠাৎ করে ফস্সা ফস্সা, দীর্ঘদেহী, খড়্গনাসা, দীর্ঘ করোটি, ব্লন্ড কেশরাশি, নিমীলিতচক্ষু আর্য ঋষি-মুনি হয়ে গিয়ে দক্ষিণহস্তে ধ্যানমুদ্রা এবং কেলে-কেলে, বেঁটে-বেঁটে, নাক চ্যাপটা, কোঁকড়ানো চুলের অনার্যদের বামহস্তে ঘাড় ধরে ‘আয় তোদের সভ্যতা শেখাই, নয়তো বনেবাদাড়ে গিয়ে চু কিত কিত খেলগে যা’ - এইসব কল্পিত কাহিনীগুলি ছোটবেলা থেকে বারবার এমনভাবেই আমাদের ‘ইতিহাস’ বলে শেখানো হয়, যা আজও ‘ইতিহাস’ বলেই আমাদের মনের গভীরে গেঁথে আছে। আর কোনো কোনো ঐতিহাসিকরা(!) এই ধর্মীয়-কাল্পনিক কাহিনীগুলিকে ইতিহাস-পুরাতত্ত্বের আরকে মাখিয়ে বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক মতবাদ (Socio-Political Doctrine) প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে এমনভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রায়-পর্যায় (Proto-history) লিখে যাচ্ছেন যা আমাদের মনে ক্রমশ ওপরের বিশ্বাসগুলোই সুদৃঢ় করে তুলছে।
এবং আমি ও আপনি, আজ্ঞে হ্যাঁ আমি ও আপনি, আসুন একহাত ইতিহাস হয়ে যাক বলে পুরাণ, ইতিহাস, এর ওর তার লেখা ইতিহাস নামে গপ্পের বই, নিজ মস্তিষ্কের গপ্পো মিশিয়ে ভারতীয় ইতিহাসের প্রায়-পর্যায় নিয়ে গলায় মালা দুলিয়ে দু’হাত তুলে কেত্তন করছি। এবং বিশ্বাস করুন স্যার ও ম্যাডাম মহোদয়/দয়াগণ আমরা কিন্তু সবাই মিলেই সেইগুলো তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি।
ভাষাতত্ত্ব না আমসত্ব
----------------------------
পৃথিবীর কোন ভাষাতেই মৌখিক আর লিখিত ভাষা কি এক? আপনাদের কাছে আমার এই প্রশ্ন জারি রইল। আমরা যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করি, সেই ভাষাতেই কি কথা বলি? পুরুলিয়ার কিংবা সিলেটের মানুষ যাঁরা প্রত্যেকেই বাংলাভাষী, তাঁরা যখন বাংলাভাষায় লেখেন, বিশেষ করে ধর্মীয় কাহিনী, তাঁদের লেখা কি তাঁদের কথ্য ভাষায় লেখেন? না, কখনই নয়। অথচ ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন লিখিত ঋগ্বেদের ভাষাতেই সেইযুগের মানুষেরা কথা বলতেন।
ক্ষী আশ্চুর্যি, বলিহারি বুদ্দি বটে!
আমাদের পঠিত ইতিহাস বলে, বেদ-এর অপর নাম শ্রুতি, কেননা, সুদীর্ঘকাল ধরে তার স্তোত্রগুলি গুরুশিষ্য পরম্পরায় মৌখিকভাবেই রচিত ও মুখস্ত করা হয়ে আসছে। এই বেদ-এর প্রথমভাগ হল, ঋগ্বেদ। পাণিনি বলে এক ভদ্রলোক সংস্কৃত ভাষায় ‘অষ্ট্যাধ্যায়ী’ নামে এক ব্যাকরণগ্রন্থ লিখেছিলেন, ঐ ধরুন ৫০০ খ্রিঃপূঃ নাগাদ। তিনি সেই বইতে সংস্কৃত ভাষার কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, যাতে ভাষাটি এলোমেলো না হয়ে যায়। এখন মজা হল, এই সংস্কৃত ভাষার থেকে নাকি ঋগ্বেদের ভাষা প্রাচীন ও পৃথক। এবার মঞ্চে প্রবেশ যাস্ক নামক এক ভদ্রলোকের। যাস্ক তাঁর নিরুক্ত গ্রন্থে ঋগ্বেদ-এর ব্যাখ্যা করেছেন, ভাষ্য রচনা করেছেন সংস্কৃত ভাষায়। কেন? না তৎকালের পণ্ডিতরা ঋগ্বেদের ভাষাই বুঝতে পারছেন না, তাই ঋগ্বেদকে তখনকার কথ্যভাষা সংস্কৃতয় বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
তাহলে ঋগ্বেদ রচিত হল কোন ভাষায়?
‘Indo-Aryan’ - আকাশ থেকে ভেসে এল বানী।
তা এই Indo-Aryan-টা কি বস্তু?
Proto-Indo-European Language হল, ‘সভ্যতার জন্মভূমির ভাষা’। সেখান থেকে বিভিন্ন দলের পশুচারক ও পালকরা বিভিন্ন দিকে হাঁটা লাগাল। তারই মধ্যে একদল পশুচারক ও পালক হেঁটে হেঁটে যখন পা ব্যথা করতে লাগল, তখন ইরানে একটা লাঞ্চব্রেক দিলো। তখন তারা যে ভাষায় কথা বলত তার নাম হল, Indo-Iranian। জন্ম হল ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’-র। তারপর, আবেস্তার ভাষায় (Indo-Iranian) কথা বলা লোকগুলোর মধ্যে কোনও কোনও বিষয় (যেমন, দেব-দেবতা সংক্রান্ত - অগ্নি বড় না ইন্দ্র বড় ইত্যাদি) নিয়ে লাগল তুমুল ঝগড়া। তখন তাদের মধ্যে থেকে একদল (ইন্দ্রের সমর্থকরা) রাগ করে হাঁটা লাগাল আরও দক্ষিণ-পুবে। এদিকে হল কি, যত হাঁটছে তত তাদের কথ্যভাষা পাল্টাচ্ছে। পাল্টাতে পাল্টাতে তারা যখন হিন্দুকুশ টপকাল, বদলে যাওয়া আবহাওয়ায় এসে পড়ল, তখন সিন্ধুর বিমোহিত রূপ দেখে উদ্বেল হয়ে গিয়ে তাদের কথ্যভাষাটাই পাল্টে হয়ে গেল Indo-Aryan।
কি মজার গল্প না!
ভারতীয় উপমাহাদেশে এসে এদিক ওদিক গরু, ভেড়া, ছাগল চড়াতে চড়াতে আর তাদের ন্যাজ মুচড়ে হ্যাট হ্যাট করতে করতে সেই মানুষগুলি Indo-Aryan ভাষায় রচনা করে ফেলল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম গ্রন্থ - ঋগ্বেদ। পরবর্তীকালে ঋগ্বেদ যখন লিখিত আকারে সংস্কৃত ভাষায় সংকলিত হল, তখন শ্রুত হওয়া ঋগ্বেদের Indo-Aryan ভাষাটাই পাল্টে গেল। মুখে মুখে রচিত ও গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখস্ত করা স্তোত্রগুলির অর্থও কি পাল্টাল? স্তোত্রগুলো কথ্য Indo-Aryan থেকে ব্যাকরণ কাঠামো-সমৃদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় লিখতে গিয়ে কি একই অর্থ বহন করল? কোন লিপিতে লেখা হল, ব্রাহ্মী না দেবনাগরী নাকি অন্য কোন লিপিতে? প্রথমবার যে লিপিতে লেখা হল, সেই লিপিতে লেখা মূল পুঁথিগুলির হদিশ কেউ জানেন?
ইওরোপিয়ান ভাষাতাত্ত্বিকদের এই পুরো গপ্পোটা মানতে গেলে আমাদের মেনে নিতেই হবে, ৩৫০০ বছর আগে উত্তর-পশ্চিম ভারতের বৈদিক মানুষেরা ঋগ্বেদের ভাষার মতো একটি ধর্মীয়, নাটুকে, কাব্যের ভাষায় সমাজে কথা বলতেন!
ভাষা-ভাষা ভাই-ভাই
----------------------------
১৭৮৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী, স্যার উইলিয়াম জোন্স কলকাতায় রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল-এর সভায় এক ভাষণে বললেন, সংস্কৃতর সঙ্গে তিনি ল্যাটিন, গ্রিক, রোমান, কেল্টিক ও অন্যান্য ইওরোপিয়ান ভাষার বহু সাদৃশ্য পেয়েছেন। একজন আইনজীবী, ভাষাতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিচারক হিসেবে তাঁর সেই কথার ওজনই আলাদা মাত্রার হয়ে উঠল। জোন্স মশাই-এর এই ভাষা-সাদৃশ্যের তত্ত্বের ভাষন দেওয়ার ‘সময়’টা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন?
১) অর্থনৈতিক - সেইসময়ই আমেরিকার বেশিরভাগ উপনিবেশগুলো ব্রিটিশদের হাতছাড়া হয়ে গেছিল এবং উপায়হীন ব্রিটিশরা বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেছিল,
২) রাজনৈতিক - ইওরোপে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের (Nation-State) উদ্ভব শুরু হয়েছিল। সুতরাং 'এক জাতি - এক প্রাণ - একতা' এই আবেগটির প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল।
৩) সাংস্কৃতিক - ক) বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যপ্রমাণে মনুষ্য-উৎপত্তির বাইবেলগত ধারণা পরিত্যক্ত হয়ে গেছিল, এবং খ) সদ্য উপনিবেশ তৈরি হওয়া ভারতে হিন্দু উচ্চবর্ণের নিজস্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও প্রাচীনত্ব সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল।
ক্রমশ...
২য় পর্বের লিংক -
https://www.facebook.com/groups/sukumarray/permalink/2352187834796562/
Comments
Post a Comment